সিলেট: রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে উন্নয়নের মূল ধারায় সামিল হতে চান হিজড়া জনগোষ্ঠীও। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চান।
সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেদের জীবন কাহিনীর বর্ণনা দিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী কাইয়ুম, ফাহাদ ও চাঁদনী হিজড়া এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে পৈত্রিক নিবাস হলেও কাইয়ুম হিজড়া বহু বছর সিলেট নগরীর বাসিন্দা। সিলেট নগরীতে লন্ড্রি ব্যবসায়ী আব্দুল কাইয়ুম (৩০)। এই ব্যবসার টাকাতেই চলছে মা ও ছেলের জীবন। বোনের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও বহন করেন তিনি। পরিবারের অন্যরা সবাই স্বাভাবিক নারী-পুরুষ। ব্যতিক্রম কেবল তিনি। অবশ্য নিজের জীবন নিয়ে দুঃখ কষ্ট, আক্ষেপ থাকলেও সৃষ্টিকর্তার প্রতি মোটেও অসন্তুষ্ট নন তিনি। বিষয়টিকে ‘উপরওয়ালার ইচ্ছে’ হিসাবেই দেখেন। তবে মাঝেমধ্যে সন্তান আর স্বাভাবিক একটা জীবনের জন্য তারও আফসোস হয়, ‘জীবনটাকে কেমন বিরান বিরান লাগে!’
আলাপরচিতায় কাইয়ুম জানালেন, তিনিও অন্যদের মতো হিজড়াবৃত্তিতে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তবে সঠিক পথে উপর্জনের আকাঙ্ক্ষ থাকলেও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বছর পাঁচেক আগে তার মাকে দিয়ে একটা এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সামান্য সেই পুঁজিতে নগরের লামাবাজারে দোকান জোগাড় করে নেমে পড়েন লন্ডি ব্যবসায়। অবশ্য এর আগে অভিজ্ঞতার জন্য মাসখানেক কাজ করেছিলেন অন্য একজনের লন্ড্রিতে। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজে নেমে পড়েছিলেন একেবারে আঁটঘাট বেঁধে। শুরুর দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন তিনি বেশ ভালোই চলছেন। মায়ের দেখাশোনার পাশাপাশি বোনের সন্তানদেরও স্কুলে দিচ্ছেন। ওদের পড়ার খরচ জোগাচ্ছেন। বোনের সন্তানদের মাঝে খোঁজে বেড়ান নিজের অস্তিত্ব।
কাইয়ুম বললেন, এই যে আমাকে দেখছেন ব্যবসা করছি। কিন্তু আমাকে এই পাঁচ বছর পরেও অনেক সমস্যা মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে। কখনো কখনো পরিচয় বুঝতে পারলে নিষ্ঠুরতার মুখোমুখিও হতে হয়।
৩০ বছর ফাহাদ হোসেন (ছদ্ম নাম) সিলেট নগরীর এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জন্মগতভাবে শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মেছিলেন। অবশ্য পরিবারের সদস্যরা তার পাশে ছিলেন সবসময়। বারবার বাধাগ্রস্ত হলেও তিনি তার শিক্ষাজীবন চালিয়ে গেছেন। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, তারপর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ফাহাদের বক্তব্যও একই রকম। কখনো কখনো তার কাছে চেনাজানাদের ব্যবহারও অসহনীয় হয়ে যায়। অনার্স শেষ করে চাকরির চেষ্টায় ঘুরতে ঘুরতেও কিছু হয়নি।
তিনি বলেন, একটা সরকারি চাকরির বড়ই স্বপ্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। কি আর করা, বসেতো থাকা যায় না। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে বেসরকারি চাকরির চেষ্টা করি, সেটিও হলো না। শেষ পর্যন্ত একটা এনজিওতে কাজ জুটে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে চাকরিটা অনেক ছোটো। বিকল্পতো নেই। তাই সেটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চাঁদনী হিজড়া (২২) বলেন, আট বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে আসি। স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে মিলে ওদের দুঃখ কষ্ট দেখি আমার মতো। প্রথম দিকে গুরুমার অধীনে কালেকশন করে জীবনযাপন চলতো। কিন্তু আমি অন্যদের মতো না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজে অনার্স পড়ছি। হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে কাজ করছি। সে সুবাধে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বন্ধুর প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে পড়ালেখাও বন্ধ করে দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা সরকারের কাছ থেকে ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাদের মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। আমরা এই দেশের নাগরিক। এই দেশের সন্তান হয়েও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রী অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ছিন্নমূল, বাস্তুহারা মানুষকে ভূমি দিয়েছেন। ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একটু মানবিক হয়ে আমাদের বাসস্থান ও সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিলে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
তাদের মতে, সুযোগ পেলে কোনো হিজড়াই পঙ্কিল জীবন যাপন করতো না। প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও তারাতো পারছেন, কারও মুখাপেক্ষি না হয়ে নিজের জীবন নিজেরাইতো চালিয়ে নিচ্ছি। কেবল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর সুযোগের অভাব রয়েছে। তাদের দাবি, সরকারি-বেসরকারি খাতে সুযোগ সৃষ্টি করে দেখুন হিজড়ারা পারে কিনা। পারবে সে উদাহরণতো তারাই। উন্নত বিশ্বের হিজড়ারা নিজেদের উন্নত জীবনযাপন করার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশেও সুযোগ পেলে ফাহাদ, কাইয়ুম, চাঁদনীরাও যে পারবে, এ ব্যাপারে সচেতন অনেকেই একমত পোষণ করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২১
এনইউ/এএটি