ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ফাল্গুনে সজনে, চুপে চুপে ঝরে পড়ছে ফুল

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১
ফাল্গুনে সজনে, চুপে চুপে ঝরে পড়ছে ফুল সজনে ফুল। ছবি: বাংলানিউজ

পাবনা (ঈশ্বরদী): ‘...আনারস বন; ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে’। সজনে ফুল দেশের গ্রামের মানুষের কাছে চির-চেনা হলেও কবি-সাহিত্যিকরা কিন্তু খুব বেশি এর কথা বলেননি।

তবে বাংলা সাহিত্যের দেশাত্মবোধক কবিতায়, শ্যামল বাংলার প্রকৃতির কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি’ কবিতায় সজনে ফুলের কথা পাওয়া যায়।

‘ও আমার বাংলা মা তোর- আকুল করা রুপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’ গানের ছন্দে মনে হয় মাটিতে কচি দূর্বা ঘাস আর সজনে ফুল যেন আবহমান এই বাংলার এক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য সকলকে মনে করিয়ে দেয় প্রিয় শ্যামল বাংলার প্রকৃতিতে ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে গাছে গাছে দুলছে নান্দনিক সজনে ফুল। আর সজনে ফুল ঝরে পড়ছে।

ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে গ্রামাঞ্চলে গাছে গাছে ভরে গেছে সবুজের মধ্যে সাদা সজনে ফুল। ফাল্গুন মাস জুড়ে সজনে গাছে ফুল আসার মৌসুম। চৈত্র মাসে ফুল থেকে হয় সবুজ ডগা, আর বৈশাখে সজনে।

সবার কাছেই খাদ্য হিসেবে সুস্বাদু বেশ প্রিয় তরকারি। বৈশাখের গরমে পানতা ভাত ডাল সজনের সুস্বাদু তরকারি সব গ্রামের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কাছে অনেক প্রিয় খাবার।  

সজনে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম মরিঙ্গা অলিফেরা ইংরেজিতে গাছটিকে মিরাকল ট্রি বা অলৌকিক গাছ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পুষ্টিবিদদের মতে, সজনে গাছ ৩০০ ধরনের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। সজনের বাকল, শিকড়, ফুল-ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ঔষধি গুণ আছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং মৌসুমি সবজির মধ্যে সজনে অন্যতম। যা দেশের সব গ্রামাঞ্চলে পাওয়া যায়। ড্রামস্টিক, মরিঙ্গাসহ দেশে-বিদেশে সজনা বহু নামে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে সজনে নামেই পরিচিত। সজনের বহুবিধ ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে।

সরেজমিন ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, ঈশ্বরদীতে উপজেলায় প্রচুর সজনের গাছ রয়েছে। শীতের রিক্ততা কাটিয়ে এখন ফুলে ফুলে ভরে গেছে সজনে গাছ। যত্নে নয় তবে রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায় এবং ডোবা নালা পুকুরের আশেপাশে, অযত্ন আর অবহেলায় গাছে গাছে বাতাসে দোল দিচ্ছে সজনে ফুল। অথচ কিছুদিন পরই বেশ কদর বাড়বে। একটি সজনে গাছ থেকে গৃহস্থ কয়েক মণ সজনে বিক্রি করে কয়েক হাজার টাকায়। আর বহুগুণে গুণান্বিত যাদুকরি সবজি সজনে। ঔষধি গুণাগুণে ভরা কিন্তু কোনো উৎপাদন খরচ নেই, অধিক লাভজনক। বাজারে ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন সবজি সজনে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, সজনেতে আ্যানিমিয়া, জয়েন্ট পেইন, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, হার্ডপেইন, ব্লাডপেসার, কিডনিতে পাথর ধ্বংস, মায়ের দুধ বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন ঔষুধি গুণাগুণ রয়েছে। সজনে গাছকে প্রচলিত বিভিন্ন খাদ্য প্রজাতির মধ্যে সর্বোচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন উদ্ভিদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বহুবিধ খাদ্যগুণ সম্পন্ন হওয়ার দক্ষিণ আফ্রিকায় সজনে গাছকে যাদুকরী গাছ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

শৈশবের স্মৃতিচারণ করে ঈশ্বরদী শহরের  জুয়েল মাহমুদ বলেন, বাড়ির সামনে সজনে গাছে ফুলে ফুলে ভরে যেত। সারাদিন সাদা ফুলগুলো টুপটাপ করে ঝরতো। গাছ তলা সাদা হয়ে থাকতো। কিছুদিন পর গাছে সজনে ডাটা দেখা যেতো। সহজে কেউ গাছে চড়তেই পারতো না। ব্যঙ্গ করে তিনি বলেন, দুষ্টুমি করার পর মায়ের পিটুনি থেকে রক্ষা পেতে দৌড়ে সজনে গাছে চড়ে বসতাম। সজনে গাছের ডাল খুব নরম, যে কোন ডালে পা রাখলে মড়মড় করে ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে যেতাম। গাছ থেকে সজনে ডাল নিয়ে ভেঙ্গে পড়তাম। সজনের জন্যই মায়ের পিটুনি থেকে রক্ষা পেতাম।

ঈশ্বরদী শহরের রেলগেট এলাকায় সবজি ব্যাবসায়ী সেলিম উদ্দিন প্রায় ৪০ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বাংলানিউজকে জানান, গ্রামাঞ্চল এলাকায় এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়িতে সজনে গাছ নেই। গ্রামের মানুষ হাট-বাজারে বিক্রি করেন। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়নি ঈশ্বরদীতে। প্রথমে দামটা ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও কমতে কমতে ২০ টাকা কেজিতে নেমে আসে। শুধু গ্রামেরই মানুষের কাছেই নয়, শহরের মানুষের কাছেও সজনে ডাটার ব্যাপক কদর রয়েছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) শফিকুল ইসলাম শামিম বাংলানিউজকে জানান, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বাড়ায় আবার আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় ভাইরাসজনিত অসুখকে দূরে রাখে সজনে। প্রচুর ফসফরাস থাকায় হাড়ের জোর বাড়াতে সাহায্য করে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ও রক্তাল্পতা কমাতে সজনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। হার্টের অসুখ দূরে ঠেকাতেও এই সবজি কার্যকর। জলবসন্ত রোগ ঠেকাতে সজনে খুবই কার্যকর। বসন্তে অসুখ ঠেকাতে প্রতি দিনই খাওয়ার তালিকায় সজনে ডাটা বা সজনের ফুল রাখা দরকার।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মীর হুমায়ুন কবীর বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, বসন্তের শুরুতে চারদিকে যখন লাল-হলুদ রঙের ফুলের সমারোহ, তখন সাদা রঙের সজনে ফুল শুভ্রতা সঞ্চার করে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) সহযোগী অধ্যাপক বিপ্লব হুমায়ুন বাংলানিউজকে বলেন, কয়দিন পরে ফুলগুলো সৌন্দর্য বৃদ্ধিই নয়, বাঙালির রসনার উপকরণও হবে। সজনে ডাটার সঙ্গে ডাল কে না পছন্দ করে! এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।  

ঈশ্বরদীর মুলাডুলি ইউনিয়নের পতিরাজপুরের কৃষক নেতা মুরাদ আলী মালিথা বাংলানিউজকে বলেন, হাট-বাজারে ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন সবজি সজনে বহু গুণে ভরা, সুস্বাদু সব সজনে ডাঁটা। উৎপাদন খরচ নেই, বললেই চলে অধিক লাভজনক। ঈশ্বরদীতে তেমন সজনে চাষ হয় না। গ্রামের সব গাছে ফুলে ফুলে মৌ মৌ করছে চারিদিক। ঈশ্বরদী উপজেলায় সজনের চাষে গ্রামের বেকার যুবক, চাষিদেরকে উদ্বুদ্ধ এবং মানুষকে উৎসাহিত করতে কোন উদ্দ্যোগই গ্রহণ করেনি ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি বিভাগ। এটা জরুরী দরকার।

দেশের অনেক স্থানে প্রচুর সজনের চারা ও ডাল রোপণ করা হয়। সেই ভাবে ঈশ্বরদীতে কোনো চাষাবাদ শুরু হয়নি। দেশের সব এলাকাগুলো ফসল আবাদের অনুপযোগী, ক্ষেতের আইল, ঘরের বাঁধ এবং রাস্তার দু’পাশ দিয়ে মৌসুমি সজনের আবাদ রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা পরিক্ষামুলকভাবে সজনে চাষ যদি শুরু করেন তা হলে স্বল্প খরচে লাভবান হতে পারে কৃষক। এতে অর্থনৈতিকভাবে অনেকেই লাভবান হতে পারেন বলে মনে করেন অনেকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।