সিলেট: মাছে ভাতে বাঙালি। প্রবাদটির যৌক্তিকতা-গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা দুধের গরু।
এশিয়ার বৃহত্তম মিঠাপানির হাওর হাকালুকিতে স্থানীয়দের কাছে এই দৃশ্য নতুন নয়। তবে, বেড়াতো যাওয়া যে কারো জন্য এটা পিলে চমকে যাওয়ার মতো। ইজারাদার পক্ষের লোকজন প্রতিনিয়ত বিশালতম হাকালুকির বুক থেকে মৎস্য আহরণ করে ডাঙায় এনে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। প্রতিটি খাঁচাভর্তি মাছের চালান ২০ থেকে ৪০/৪৫ হাজার টাকায় ডেকে ডেকে বিক্রি চলছে। সরেজমিন দেখা যায়, সিলেট ও মৌলভীবাজারের ছয় উপজেলাজুড়ে বিস্তীর্ণ হাকালুকির বুকে ইজারাদার পক্ষের লোকজনের মৎস্য আহরণের দৃশ্য। চারণভূমি বেষ্টিত হাকালুকির মাঝখানে জলাশয়ে পানির পরতে পরতে যেনো মাছ আর মাছ। হাওরের যেকোনো এক প্রান্তে দাঁড়ালে দেখা মিলে কুদালি, দৈরল, লেইঞ্জা, সাদা বক, কানা বকসহ হরেক রকমের পরিযায়ী পাখির। হাওরের মধ্যে চারণ ভূমিতে বাতানে শত শত মহিষ আর গরু চড়াচ্ছেন রাখালরা। জেলেরা জাল দিয়ে নৌকাভর্তি মাছ নিযে ঘাটে আনছেন। খাঁচায় উঠিয়ে সেই মাছ আনা হয় অস্থায়ী আড়তে। মাছ আড়তে ফেলতেই ক্রেতাদের মধ্যে শুরু হয় উচ্চস্বরে হাঁকডাক। প্রতিটি খাঁচায় ভর্তি মাছ তুলনা ভেদে ২০ থেকে ৪৫/৫০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। আড়তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মোড়ল লাঠির ইশারা করে ক্রেতা নির্ণয় করেন। দাম কম কিংবা বেশি, তিনি যাকে মাছের ক্রেতা মনে করবেন, তাতে যায় আসে না, তিনিই ক্রেতা। প্রতিদিন দুপর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এভাবে মাছ বিক্রি চলে হাকালুকি হাওরে। প্রতিদিন হাকালুকির হাওরে ২৫/৩০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয় জানান সংশ্লিষ্টরা।
ইজারাদার পক্ষের লোকজন জানান, সরকার থেকে ইজারা নেওয়া হাকালুকির হাওরে প্রায় ৩ বছর পর পর চলে মৎস্য আহরণ। এবছর মৎস্য আহরণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রায় দেড়মাস ধরে মৎস আহরণ চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ব্যবস্থাপনায় থাকা ইজারাদার পক্ষের ইশফাকুল হোসেন সাব্বির বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি ৩ বছর পর পর মৎস্য আহরণ করায় আকারে মাছ বড় হয়। মাছের প্রজনন বাড়ে। হাকালুকিতে এমনও বোয়াল-আইড়, গ্রাস কার্প মাছ আছে ওজনে ৩০/৪০ কেজিও হবে।
তিনি বলেন, হরেক রকম বড় মাছের মধ্যে বোয়াল, আইড়, গ্রাসকার্প, রুই, কাতল, মৃগেল, কালো বাউশ, পাখি রাঙ্গা, চিতল, গুলশা, পাবদা, গলদা চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ছে। পাইকাররা সেসব মাছ গাড়িতে করে নগর-শহর, গ্রামগঞ্জের বাজারে বিক্রি করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এশিয়ার বৃহত্তম মিঠাপানির হাওর হাকালুকি। এটি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গ কিলোমিটার। হাওরটি ৬টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৩৮ শতাংশ বড়লেখায়, ২ শতাংশ জুড়িতে, ৩০ শতাংশ কুলাউড়ায়, ১৫ শতাংশ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ শতাংশ গোলাপগঞ্জ এবং ৫ শতাংশ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।
হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো উজানে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদী কন্টিনালা, ফানাই, আনফানাই, জুড়ি ও বরুদল মিলেছে হাকালুকি হাওরে। হেমন্তে এই হাওরের পানি শুকিয়ে চারণ ভূমিতে পরিণত হয়। ওই সময়ে মূল হাকালুকিতে মৎস্য আহরণ শরু হয়। সেসঙ্গে হাওরে প্রায় ২৩৮টি কোয়া (বিল) রয়েছে। প্রায় সারাবছরই বিলগুলোতে পানি থাকে। এই মৌসুমে এসব বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে। হাওরের মধ্যভাবে অভয়ারণ্য গড়তে লাগানো হয়েছে হিজল-করচ গাছের বাগান। যা মুগ্ধ করে পর্যটকদের। এইজলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে ‘মিনি কক্সবাজার’ রূপ ধারণ করে। এই সময়পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার।
জীববিজ্ঞানীদের মতে, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ বিলুপ্ত প্রায়। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২শ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। শীত মৌসুমে হাকালুকির হাওরের মাঝখানে যেতে হলে ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া ইউনিয়নের মোকামবাজার হয়ে বাস, হালকা যান দিয়ে যাওয়া যায়। ভ্রমণপিপাসুরা চাইলে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে মৎস্য আহরণ দেখার পাশাপাশি হিজল-করচের বাগানের পাশে পিকনিক করে সময় পার করে দিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে পারবেন সিলেট শহরেই।
সিলেট থেকে সরাসরি হাকালুকির হাওরে যেতে মাইক্রোবাস/প্রাইভেটকার ভাড়া মূলত; সময়ের ওপর নির্ভর করে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নেবে। ভালোভাবে থাকার ব্যবস্থা উপজেলায় না খুঁজে সিলেট চলে এসে আসতে পারেন পর্যটকরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১
এনইউ/এএটি