সিলেট: বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠীর বেলায় বাংলাদেশে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না।
তেমনি সংবিধানে ২৮ (২) অনুচ্ছেদে সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা (১) প্রজাতন্ত্রে কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে-উল্লেখ থাকলেও বঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠী। একই অনুচ্ছেদে (২) কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না, কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না বলা হলেও কেবল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানোয় হিজড়া উপাধিতে ভূষিত নাগরিকরা সুবিধাবঞ্চিত রয়েই গেছেন।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদুল্লাহ শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া হিজড়াদের মানবাধিকারের অংশ। যদিও তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সংবিধানে নারী-পুরুষ ব্যতীত তাদের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। তবুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। সেই স্বীকৃতি পাওয়াটা একটি ইতিবাচক দিক। কারণ তারা জনগণের মধ্যে একটি স্বীকৃত অংশ, সেটাও তারা এখন প্রকাশ্যে বলতে পারছে। এই স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গায় সাংবিধানিক, আইনি ও মৌলিক অধিকার-সব ধরনের অধিকার দাবি করতে পারবে। এখন করছেও।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে তাদের যে জীবনমান ছিল, তারা অস্বীকৃত জনগোষ্ঠী ছিল। গোপনে আড়ালে আব্দালে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতো। মানুষ তাদের অসামাজিক অপবাদ দিতো। তাদের অসচেতনতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসামাজিকতায় তাদের লিপ্ত হয়ে থাকার অভিযোগ রয়েছে। এখন হয়তো তারা নিজেদের সচেতন করতে পারবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেরা গিয়ে ভর্তি হয়ে আত্মপরিচয় দিয়ে দাঁড়াতে পারবে।
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের একজন এমএলএ হয়েছেন। বাংলাদেশেও স্থানীয় নির্বাচনে তাদের কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সুতরাং অচিরেই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থান থেকে একটা ইতিবাচক অবস্থানে যাবে। সমাজ স্বীকৃতি আত্মপ্রত্যয়ী রূপে তারা আভির্ভূত হবে। ইতোমধ্যে তাদের জাতীয় ভিত্তিক ও জেলায় জেলায় সংগঠন হয়েছে। এনজিওদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর তাদের কিছু কিছু সহযোগিতা করছে। যদি তারা প্রাথমিক অবস্থায় এগিয়ে যেতে পারে। তাহলে সমাজে আত্ম কর্মস্থানমূলক কাজে অংশ নিতে পারবে।
অ্যাডভোকেট এমাদুল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন শারীরিকভাবে কর্মক্ষম। তারা লেখাপড়া করতে পারলে অফিস আদালতে কাজ করতে পারবে। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেটাতে অতিক্রম করতে হবে। সোশ্যাল সায়েন্স অনুযায়ী, এদেরকে শারীরিক প্রতিবন্ধী বলা হয়। তারা সংঘবদ্ধ হলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাটাও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। আমাদেরও তাদের পক্ষে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে হবে।
তিনি বলেন, হিজড়াতের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এজন্য আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা বুঝতে হবে, তারা প্রাকৃতিকভাবে এই জায়গাতে এসেছে। হিজড়া হওয়ার পেছনে তারা নিজেরা দায়ী নয়। তাদের বিষয়ে ছাত্র-শিক্ষক, সবার মধ্যে কাউন্সেলিং দরকার। সভা-সেমিনারে কথা বলা দরকার। তাদের সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে। আর নাগরিক অধিকার দিতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। নারী-পুরুষের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অথবা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করেও আইনি অধিকার দেওয়া যায় প্রতিবন্ধী কোঠায়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে। হিজড়ারাও সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। তাদের পেছনে ফেলে রেখে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে হিজড়াদের একটি জায়গায় ঘর বানিয়ে দিয়ে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। এটা সরকারের জন্য একটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। যেমনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকার দিয়ে। নির্বাচন এলে আজও চা-শ্রমিকরা জাতির জনকের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নৌকায় ভোট দেয়।
তিনি বলেন, হিজড়াদের যারা লেখাপড়া করছেন, তাদের সরকারি চাকরি সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি গার্মেন্টস সেক্টর, সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রাফিকিংয়ের কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের জীবন মানোন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি সুবিধা দিয়ে বিত্তশালীরা ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১
এনইউ/এএটি