একদল বাউল সাধক দোতারা ও ঢোলের তালে সংগীত পরিবেশন করছেন। তবে তা প্রথাগত কোনো সংগীত নয়, মানবতার গান।
নরসিংদী শহরের মেঘনা নদীর তীরে ভক্ত ও পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। মেলায় ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েকশত বাউল সাধক যোগ দিয়েছেন। বাউলরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব ধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বণি করছেন।
বাউল সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রায় সাতশ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে শহরের কাউরিয়াপাড়ার শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়ায় এ মেলার আয়োজন করা হয়। গত বুধবার শুরু হওয়া বাউল মেলা চলবে আগামী সোমবার পর্যন্ত।
বাউল সাধকরা জানান, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) ঘট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। সবার মধ্যখানে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা বৈঠক ঘর।
সেই ঘরেই দেশ-বিদেশের বাউল সাধকরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। বৈঠক ঘরে মনমোহিনী রাধে জয়, রাধে জয় - টেনে টেনে গাইছেন এক বাউল। সাথেই সতীর্থরা সুর মেলাচ্ছেন। ঢোল, খোল, করতাল আর একতারার সুরে মাথা দোলাচ্ছেন অনেকে। এই আখড়ার বৈঠক প্রচলিত বৈঠকের মতো নয়। এ বৈঠকে কেউ কথা বলেন না। শুধু সাধকের গাওয়া গানের মর্মার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়।
বৈঠক ঘরে গান গাইছিল পরিতোষ বাউল। তিনি বলেন, আমাদের গাওয়া গানগুলো সাধারন বাউল সংগীত না। এগুলো শত শত বছর ধরে চলে আসা মানবতার গান। মানবের কল্যাণের নিমিত্তেই আমাদের এসব পরিবেশনা।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বিনোদ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের বিশ্বাস, বাউল ঠাকুর জাগ্রত। বাউল ঠাকুর মনের ঠাকুর। মনে-প্রাণে ডাকলেই ঠাকুরকে পাওয়া যায়। তাই পরিবারের ও বিশ্ব মানবতার মঙ্গল কামনায় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছি।
শনিবার দেবতা ব্রহ্মার পূজা মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মহাযজ্ঞ পরিচালনা করেন পুরোহিত রিন্টু বাউল। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সব ধর্মকে মানবতার ঊর্ধ্বে তোলার জন্যই বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। তাই বাউল মেলায় বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ অংশ নেয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয়। ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।
মহাযজ্ঞে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে শত শত নারী-পুরুষ অংশ নেয়। মেলায় আসা ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে বাউল ঠাকুরের সমাধিতে প্রদীপ প্রজ্বলন করে। তা ছাড়া নিজেদের মঙ্গল চেয়ে প্রার্থনা করেন।
মেলায় আসা অনামিকা সাহা বলেন, আমরা পরিবারের লোকজন নিয়ে প্রতিবছরই বাউল মেলায় আসি। বাউল ঠাকুরের উদ্দেশে মেলায় সবার সাথে দেখা হয়। যা মিলনমেলায় পরিণত হয়।
বাউল আখড়ার অনামিকা বলেন, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কিভাবে সহজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে ভেদাভেদ বিভেদ না করে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবেসে যাচ্ছি।
অন্যদিকে, বাউল আখড়ার উৎসবকে কেন্দ্র করে মেঘনা নদী তীরের বসেছে মেলা। মেলার এক কোণে বসেছে চড়কি, নাগরদোলাসহ সাপের খেলার আয়োজন। পাশেই দুই সারিতে শ’খানেক বাচ্চাদের খেলনার দোকান। মাটির পুতুল, হাড়ি, কলসসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। সেই সাথে রয়েছে জিলেপিসহ বিভিন্ন খাবারের সমারোহ।
মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন শহরের হেমেন্দ্র সাহার মোড়ের আশিষ কুমার সাহা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আখড়ায় বাউল ঠাকুরের পূজা শেষে পরিবার পরিজন নিয়ে মেলায় এসেছি। ছেলে জন্য মাটির খেলনা কিনেছি। তাকে বেত ও মাটির বিভিন্ন সামগ্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।
শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়া এবং বাউল মেলার তত্বাবধায়ক প্রাণেশ কুমার ঝন্টু বাউল বাংলানিউজকে বলেন, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পৈত্রিক সূত্রে এই মেলার আয়োজন করে আসছি আমরা। আনুমানিক সাতশত বছরেরও অধিক সময় আগে কোনো এক বাউল সাধক এখানে এসে আখড়া স্থাপন করে মানবধর্ম ও মানবের কল্যাণের জয়গান গেয়েছেন। সেই থেকে এখানে এই আয়োজন। এখানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে যজ্ঞের মাধ্যমে সকল জীবজগত ও মানব জাতির কল্যাণ কামনা করা হয়। আমরা সকলকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করি। আমাদের মনের মলিনতা দূর করার জন্য প্রার্থনা করি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১
এমকেআর