ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নিত্যপণ্যে ব্যয় বৃদ্ধি, সঙ্কটে ভোক্তারা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২১
নিত্যপণ্যে ব্যয় বৃদ্ধি, সঙ্কটে ভোক্তারা বেড়েছে সব নিত্য পণ্যের দাম -ফাইল ছবি

ঢাকা: বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা মহামারির মধ্যে নিত্যপণ্য ক্রয়ে ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়েনি ভোক্তাদের। এ সঙ্কটে বেকার হয়েছেন অনেকেই।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনেকের বেতন কমেছে। ফলে এক সময়ের মাছে-ভাতে বাঙালি আজ ডাল-ভাতের খরচ জোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন।

গত দেড় বছরে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এতে পিষ্ট হচ্ছেন ভোক্তারা।

অন্যদিকে সম্প্রতি সরকার এলপি গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। ফলে জীবন যাত্রার ব্যয়ও আরেক দফা বাড়ছে। এতে অর্থনীতির সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি ভালো লক্ষণ নয়। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন। গত বছরে ৮ মার্চ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা ঘোষণা করা হয়। এর আগেও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। তবে সংক্রমণের পর থেকে বেড়েছে বেশি।

করোনা সংক্রমণের আগের দাম এবং শনিবারের (১৩ নভেম্বর) দাম সরেজমিনে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ঘোষণার আগে অর্থাৎ ফেব্রয়ারিতে প্রায় সবগুলো নিত্যপণ্যের দাম বর্তমান দামের চেয়ে কম ছিল। এরপর গত দেড় বছরে দাম বেড়ে জনসাধারণের নাগালের প্রায় বাইরে চলে গেছে। করোনার আগে মোটা চালের (পাইজাম) গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৪০ টাকা। গত দেড় বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়, শতাংশ হারে যা প্রায় ২৫ শতাংশ। প্রতি কেজি মশুর ডালের (দেশি) দাম করোনার আগে ছিল ১০০ টাকা। এটি বেড়ে এখন হয়েছে ১১০ টাকা, বৃদ্ধি ১০ শতাংশ। আর আকাশ ছুঁয়েছে ভোজ্য তেল। করোনার আগে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ছিল ৮৫ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ (৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ)।

অন্যান্য নিত্যপণ্যের মধ্যে মুরগি, পেঁয়াজ, চিনির দামও অনেক বেড়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা (বৃদ্ধি ৫০ শতাংশ)। চিনির দামও বেড়েছে কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম কয়েকবার ওঠানামা করেছে। চিনির দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ায় তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেবে এমন আশঙ্কা থেকে পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। এরপর সরকার যেদিন শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়, সেদিনই দাম কমে যায়। এতে ভোক্তারা অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে।

এদিকে মুরগির দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। যা আগে ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শতাংশ হারে বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গরুর মাংসের দামও বেড়েছে ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। বৃদ্ধির তালিকায় আছে ডিমও। ডজনে ৩০ টাকা বেড়ে বর্তমানে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায় (বৃদ্ধি ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ)।
তাছাড়া বর্তমানে প্রায় ৬ থেকে ৮টি সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। অথচ এসব সবজি আগে পাওয়া যেত ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি।

করোনার আগে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। কয়েক দিন আগে তা বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা। (বৃদ্ধি ২৩ শতাংশ)। আগে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ১১০০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে সেটি হয়েছে ১৩১৩ টাকা (বৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ)।

এ বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, করোনার মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু বেতন কমেছে ৩০ শতাংশ। ফলে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে সংসার চালাতে এখন নাভিশ্বাস উঠছে।

তিনিআরও বলেন, ‘আমি কী বলব, তা বুঝতে পারছি না। কয়েক মাস ধরে ঋণ করছি। ঋণের টাকায় সংসার চলছে; আর কতো? বেতন বাড়েনি এক টাকাও, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।

এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কতটা সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বর্তমান বাজারে চাল, ডাল, তেল, লবন, চিনি থেকে শুরু করে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামও বেড়েছে।
এসব পণ্যের দাম বাড়ায় গত কয়েক বছরের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। সেই তুলনায় বাড়েনি আয় রোজগার।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেবে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত, এই বছরের মার্চে সেই পরিমাণ পণ্য ও সেবা নিতে ব্যয় করতে হয়েছে ২৯২ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে একই পণ্য ও সেবা কিনতে ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হয়েছে। শতকরা হিসেবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গত বছরের মার্চে ৩০১ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ কিনতে এই বছরের মার্চে ব্যয় হয়েছে ৩১৮ টাকা। আলোচ্য সময়ে এতে বেশি ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে। গত বছরের মার্চে ২৪৬ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্যবহির্ভূত পণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ পণ্য কিনতে এখন ব্যয় হচ্ছে ২৫৯ টাকা। বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৩ টাকা। পল্লি এলাকায় সাধারণ খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকে, শহরে বেশি থাকে। এছাড়া গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সবাই চাই, দুটো ডাল ভাত খেয়ে যেন সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু দিন দিন যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে ডাল ভাতও খাওয়া যাবে না। দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে। ’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতির চাপ ধনীদের স্পর্শ করবে না। তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অভিঘাত তৈরি হবে৷ তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক ভুল। প্রণোদনা হিসেবেও এ ব্যয় সমন্বয় করা যেত। আর ধর্মঘট করে চাপ দিয়ে বাসের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে নেওয়া রাজনৈতিক দুর্বলতার ফল। সর্বোপরি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি। নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি, রাজনৈতিকভাবেও এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে নিত্যপণের দামের যে পরিস্থিতি তাতে সরকার যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে দমন করতে না পারে, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তবে সব পণ্যের দাম যে সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে, এমনটা নয়। অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেও বেড়েছে। সেটা বাড়া স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, অর্থনীতির একটা নিয়ম হলো, সাপ্লাই কমলে দাম বেড়ে যায়। এখন এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমটি হলো, যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে, সেসব পণ্য সরকারকে নিজে বিক্রি করতে হবে ভোক্তাদের কাছে। আর দ্বিতীয় সমাধান হলো, যখন সঙ্কট দেখা দেবে তখন পণ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সবজির দাম বেড়েছে, কিন্তু সবজি আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি না। আবার আমদানি করতে গেলে দেখা যাবে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম কমিয়ে দিল। তখন যারা আমদানি করল, তারা বিপদে পড়বে। এমন নানামুখি সঙ্কটে রয়েছে দেশের বাজার ব্যবস্থা। এসব সমস্যা থেকে বের হতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা যায়, গত মাসের চেয়ে নভেম্বরে ডাল ও তেলের দর বাড়িয়ে পণ্য বিক্রি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটি। টিসিবির ট্রাকসেলে একজন ক্রেতা দিনে ৫৫ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ দুই কেজি চিনি, ৬০ টাকা কেজি দরে দুই কেজি মসুর ডাল, ১১০ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল এবং ৩০ টাকা দরে আড়াই কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারবেন। এর আগে ডাল কেজি প্রতি ৫৫ ও তেল ১০০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করতো। দেশব্যাপী ৪০০ থেকে ৪৫০ জন ডিলারের ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে এ বিক্রি কার্যক্রম চলছে। রাজধানীসহ সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে চিনির পাশাপাশি মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে টিসিবি। ২৮ নভেম্বর (শুক্রবার ছাড়া) পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৪০ লাখ। করোনার কারণে গত বছর চাকরি হারিয়েছেন ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনায় রাজধানী ঢাকায় ৭৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ‘লেবার রিসোর্স অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার’ (বিলস) নামের একটি সংস্থা বলছে, করোনাকালে দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এ সময় আয় কমে যাওয়ার কথা বলছে, ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনায় ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। আর ঋণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২১
জিসিজি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।