ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুজিব শতবর্ষের ঘর পেতে কাউন্সিলকে দেড় লাখ টাকা

সুমন কুমার রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২১
মুজিব শতবর্ষের ঘর পেতে কাউন্সিলকে দেড় লাখ টাকা মুজিববর্ষের উপহারের ঘর।

টাঙ্গাইল: আব্দুল খালেক মণ্ডল (৬৫)। তার নিজের জমি নেই।

নেই থাকার ঘর। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌর এলাকার হিজলী গ্রামে ছোট একটি চায়ের দোকান রয়েছে তার। এ দোকান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই তিনি এবং স্ত্রী ছালেহা বেগমের কোনোমতে দিন চলে যায়।  

দীর্ঘদিন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে গত তিন মাস আগে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে উপহার হিসেবে তিনি ঘর পেয়েছেন। ঘর পেয়ে খুশি হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এখন সেই ঘরই ‘মরার উপর খরার ঘায়ে’ পরিণত হয়েছে।

শুক্রবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিন কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হিজলী গ্রামের ওই আশ্রয়ন প্রকল্পে গেলে আব্দুল খালেক মণ্ডল বলেন, ঘরগুলো নির্মাণ করা হলেও উপকারভোগীদের যাতায়াতের জন্য কোনো রাস্তা নেই। তাই বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়ির ওপর দিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে তাদের।

জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরিব অসহায় মানুষদের মাঝে জমিসহ ঘর উপহার দেন। এরই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে হিজলী গ্রামে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। গত তিন মাস আগে ঘরগুলো উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মো. সবদের মিয়া। ঘর পেয়ে উপকারভোগীরা খুব খুশি হলেও কাউন্সিলর সবদের মিয়াকে আগামী এক বছরের মধ্যে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে এমন নির্দেশনা থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ওইসব উপকারভোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২টি ঘর নির্মাণের জন্য এলেঙ্গা পৌরসভায় কোনো খাস জমি না থাকায় পৌর কাউন্সিলর মো. সবদের মিয়া জমি দেন। ইতোমধ্যে ১০টি ঘর নির্মাণ করে তা উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তরও করা হয়েছে। হস্তান্তরের পর কাউন্সিলর সবদের সব উপকারভোগীদের তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে প্রতি ঘরের জন্য দুই শতাংশ জমির মূল ৭০ হাজার টাকা এবং দলিল ও নির্মাণ করা ঘরের মালামাল আনা-নেওয়ার খরচের জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেন। এতে সবাই ঘর পাওয়ার খুশিতে রাজি হলেও এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে কেউ ৩০ হাজার টাকা আবার কেউ ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়েও দিয়েছেন। বাকি টাকা আগামী এক বছরের মধ্যে না দিতে পারলে সরকারের পাওয়া উপহার হিসেবে ঘরটি ছাড়ার ভয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।

হিজলী গ্রামের আবুল হাশেম মিয়া জানান, আশ্রায়ন প্রকল্পের নির্মাণ করা ঘরের জমি কাউন্সিলর সবদেরের। তবে সবদের ওই জমি হায়াতপুর গ্রামের মো. খোরশেদ আলমের কাছ থেকে কিনেছিলেন। সেই ক্রয়কৃত জমিতে ১৮ শতাংশ খাস জমিও রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু গ্রামের প্রচলিত নিজের জমির সঙ্গে খাস জমি থাকলে সেটি নিজেরই হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উপকারভোগী স্বামী পরিত্যক্তা পারভীন বেগম। থাকেন একমাত্র মেয়ে পপিকে নিয়ে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সরকারের উপহার দেওয়া ঘরে। কিন্তু জমির মূল্য এবং দলিল ও অন্যান্য খরচ দেওয়ার সামর্থ্য নেই তার। এ কারণে তার ভাই শাহীন টাকা দিয়ে জমিটি ক্রয় করে দিয়েছেন।  

পারভীন বেগমের মেয়ে পপি জানান, তাদের কোনো টাকা পয়সা, জায়গা-জমি নেই। তাই মামা টাকা দিয়ে দুই শতাংশ জমি কিনে দিয়েছেন। জমিটি মায়ের নামেই দেওয়া হয়েছে।

আরেক উপকারভোগী সন্তোস জানান, তার সংসারে সদস্য সংখ্যা নয়জন। তার মা এবং মেয়ে দুইজনেই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। মা এবং মেয়ের চিকিৎসার জন্য নিজের বসতবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এরপর অল্প মূল্যে নদীর পাড় ঘেঁষে তিন শতাংশ জমি ক্রয় করে ছোট একটি টিনের ঘর তৈরি করেন। সেই ছোট টিনের ঘরেই তার নয় সদস্যের বসবাস। এরই মধ্যে স্থানীয় কাউন্সিলর সবদের তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর পাইয়ে দেন। বিনিময়ে ঘর নির্মাণের জন্য দুই শতাংশ জমি প্রতি শতাংশ ৩৫ হাজার টাকা করে দিতে বলেন। এতেই তিনি রাজি হয়ে যান। এরই মধ্যে তিনি ৩০ হাজার টাকা দিয়েও দিয়েছেন। বাকি টাকা ধীরে ধীরে দিতে চেয়েছেন।

আব্দুল খালেক মণ্ডল জানান, ঘর নির্মাণ করা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা নিয়েছেন কাউন্সিলর সবদের মিয়া। এর মধ্যে সাড়ে নয় হাজার টাকা জমি দলিল করার জন্য এবং বাকি টাকা ঘরের নির্মাণসামগ্রী (ক্যারিং খরচ) আনার জন্য। আর দুই শতাংশ জমির মূল্য আগামী এক বছর পর দিতে হবে বলে তাকে কাউন্সিলর জানিয়েছেন।  

তবে তিনি বলেন, আমরা জানতাম যাদের জমি নাই, ঘর নাই, সরকার তাদের ঘর দিচ্ছে। কিন্তু এখন জমি কিনে আমাদের সরকারের ঘর নিতে হচ্ছে। এত টাকা দিয়ে জমি কিনতে পারলে তো আর ঘর দরকার ছিল না। তিনি এই ঘর জমিসহ উপহার দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

এলেঙ্গা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সবদের মিয়া বাংলানিউজকে জানান, এলেঙ্গা পৌরসভায় ঘর নির্মাণের জন্য সে সময় কোনো খাস জমি ছিল না। তাই তৎকালিন ভূমি অফিসের নায়েবের পরামর্শে তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য জমি দেন। উপকারভোগীদের কেউ ঘর নির্মাণের জন্য দেওয়া দুই শতাংশ জমির মূল্য পরিশোধ করেননি। তবে দলিল এবং অন্যান্য খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বাংলানিউজকে জানান, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সরকার যে ঘরগুলো উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করেছেন সেগুলো জমি সহই করা হয়েছে। তবে এলেঙ্গা পৌরসভার বিষয়টি তিনি জানেন না। আর উপকারভোগীদের কাছ থেকে কেউ ঘর নির্মাণের জন্য দুই শতাংশ জমির মূল্য নিয়ে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।