রাবি: উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সর্বত্র। এ কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন কবি, সাহিত্যিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীসহ বিশিষ্টজনরা।
তারা বলছেন, হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের জন্য একজন হীরকখণ্ড ছিলেন। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়। তার চেতনা ও মূল্যবোধ জাতির বিবেককে বহুকাল ধরে জাগ্রত রাখবে। তিনি সবার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, হাসান আজিজুল হকের চলে যাওয়া এক বিশাল নক্ষত্রের পতন। তার চলে যাওয়াতে বাংলা শিল্প-সাহিত্য এক বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো। তবে তিনি তার অবদানের জন্য বাঙালির হৃদয়ে চিরজাগরূক থাকবেন। জাতি তার অবদান চিরকাল স্মরণ করবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমাদের চলাফেরা। এক সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউজিং সোসাইটিতে ছিলাম। এত বড় সাহিত্যিক হলেও ব্যক্তিজীবনে খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। তার এ মৃত্যুর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
তিনি আরও বলেন, এক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির দখলে ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তার চর্চার বিকাশে তিনি অগ্রপথিক ছিলেন। তার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, হাসান স্যার আমাদের শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকর্মী হয়েছিলাম। বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে তিনি ততদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক অনিক মাহমুদ বলেন, বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের ভাবনাতীত বিস্তৃতি। তার মধ্যদিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি সেবা দিয়ে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
বাংলা বিভাগের আরেক অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার বলেন, হাসান আজিজুল হক শুধুমাত্র একজন কথাসাহিত্যিক ছিলেন না। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের জন্য একজন হীরকখণ্ড ছিলেন। প্রগতিশীল চিন্তার যে আন্দোলন, তার অন্যতম কান্ডারী ছিলেন তিনি। তিনি অনবদ্য ও অতুল্য।
রাজনীতিবিদদের নানা সংকট সময়ে হাসান আজিজুল হক আগলে রাখতেন উল্লেখ করে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম সরকার বলেন, হাসান আজিজুল হকের চলে যাওয়া আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন সাহসী মানুষের শূন্যতা তৈরি করবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন মানুষকে হারালাম। তিনি সবসময় আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস ছিলেন। তিনি যেমন কলম দিয়ে লিখেছেন, একইভাবে তিনি লড়াইয়ের মাঠেও ছিলেন। সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তিনি জনগণের কাতারে ছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি তার লেখনি আগামী দিনে আমাদের মধ্যে প্রেরণা যোগাবে। তবে তার মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো সেটি কবে পূরণ হবে আমরা জানি না।
সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে নিজ বাসভবন হাসান আজিজুল হক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) বাদ জোহর হাসান আজিজুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ড. সাজ্জাদ বকুল।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) দুপুর ১২টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হাসান আজিজুল হকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে। দুপুর ১টা পর্যন্ত মরদেহ সেখানে রাখা হবে। পরে দুপুর ১টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
এর আগে, গত ২১ আগস্ট হাসান আজিজুল হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আনা হয়। সেখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হৃদযন্ত্রের সমস্যার বাইরেও ফুসফুসে সংক্রমণ, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতাসহ নানা সমস্যা ধরা পড়ে। পরবর্তীতে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে হাসান আজিজুল হককে হাই-ফ্লো অক্সিজেন সাপোর্টও দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. আরাফাতের নেতৃত্বে গঠিত মেডিক্যাল টিম তার চিকিৎসা করেন। দীর্ঘ ১৯ দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর ছাড়া পান প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। এরপর থেকে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালে ভারতের বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার আগে ১৯৬০ সাল থেকে তিনি কয়েকটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবে যোগদান করেন।
হাসান আজিজুল হক তার অসাধারণ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এর পাশাপাশি তিনি লেখক শিবির পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০১৮ সালে 'সাহিত্যরত্ন' উপাধি লাভ করেন। ২০১২ সালে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করে।
তার রচিত জনপ্রিয় গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রোদে যাবো, রাঢ়বঙ্গের গল্প ইত্যাদি। আগুনপাখি ও শামুক যথাক্রমে তার রচিত প্রথম ও শেষ উপন্যাস। তার লেখা গল্পসমূহ হিন্দি, উর্দু, রাশিয়ান ও জাপানিজ ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
হাসান আজিজুল হক তিন কন্যা এবং এক ছেলে রেখে গেছেন। তার সহধর্মিনী শামসুন নাহার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন>>
>>> হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির শোক
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০২১
আরআইএস