টাঙ্গাইল: আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মেহনতি মানুষের বুজুর্গ পীর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী বুধবার (১৭ নভেম্বর)।
১৯৭৬ সালের এদিনে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অধিকারবঞ্চিত অবহেলিত মেহনতি মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় আজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় সংকটের প্রতিটি ক্ষণে জনগণের পাশে থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
মজলুম জননেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আলোচনার সভার আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
এদিন ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্ত, অনুরাগীরা মজলুম জননেতা ভাসানীর সন্তোষের মাজারে শ্রদ্ধা জানাবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাগপা, ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পুস্পস্তবক অর্পণ করবে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব শিথিল হলেও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কর্মসূচি পালন করা হবে।
মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে করেছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. এআরএম সোলাইমান দিবসের উদ্বোধন করবেন।
ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সেমিনার হলে ‘মাওলানা ভাসানীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা’ শীর্ষক সেমিনার, বিকালে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ও বাদ মাগরিব ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। সেমিনারে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী সরকারিভাবে পালনের দাবি করা হয়।
বুধবার বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থিত শাহ্ নাসিরউদ্দিন বোগদাদী এতিমখানায় কোরআন খতম ও এতিমদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা হবে। এছাড়া দিনব্যাপী আলোচনা সভা, চিত্র-প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী পরিষদ, ভাসানী ফাউন্ডেশন, খোদা-ই-খেদমতগারসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) উদ্যোগে ১৫ নভেম্বর (সোমবার) বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার সকালে মজলুম জননেতার সন্তোষের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ফাতেহা পাঠ, ভোরে রাজধানীর নয়াপল্টনের যাদু মিয়া মিলনায়তনে মওলানা ভাসানীর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ফিরে দেখা: আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম চেগা মিয়া। পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে পড়ালেখায় হাতেখড়ি। তিনি মাত্র ৬ বছর বয়সে পিতৃহীন হন এবং ১২ বছর বয়সে মা মৃত্যুবরণ করেন। মওলানা ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন পাননি। ওস্তাদের কাছে মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করার পর নিজ প্রচেষ্টায় উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, অসমিয়া, আরবি ও ইংরেজি ভাষা শেখেন।
ময়মনসিংহের পীর সৈয়দ নাসিরউদ্দিন বোগদাদীর সংস্পর্শে তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তিনি ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি হন। ১৯১৫ সালে তিনি আসাম আঞ্জুমান ওলামার সভাপতি এবং ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পা বাড়ান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আজাদ সুবহানী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। ২৪ বছর বয়সে তরুণ মওলানা ভাসানী আসামে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত কুখ্যাত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেন। ১৯৩১ সালের ওই সময়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের ভাসানচরে বসবাস করতেন। অসামান্য নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে জনগণ তাকে ‘ভাসানী’ উপাধিতে ভুষিত করে।
মওলানা ভাসানী ১৯৩৭ সালে বন্যাপ্লাবিত টাঙ্গাইলে এসে কাগমারীতে আস্তানা স্থাপন করেন। ৩৫ বছর বয়সে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। তিনি আসামের ১৩ বছরের জীবনে ৮ বছরই কারাগারে ছিলেন। বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১১ বছর আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল মহকুমায় মওলানা ভাসানী নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তোলার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে সে সময় বিপুল ভোট পড়ে। ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার রাজনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্র স্থাপন করেন।
আপসহীন সংগ্রামী নেতা মওলানা ভাসানী সময়োপযোগী ও অগ্রগামী এবং দূরদর্শি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি দলের সভাপতি মনোনীত হন।
১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দেওয়া নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়। তিনি দল ত্যাগ করে কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসন সংগ্রামের ডাক দেন। পরে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৮ সালের আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি হন। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকায় পল্টনের জনসভায় চোরাচালানের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব ব্যক্ত করেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে ভারত গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার এবং মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সে বছরের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০২১
এএটি