সিলেট: পুলিশে চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছেন অনিকা বেগম। নারী কোটায় প্রথম স্থান লাভ করেছেন তিনি।
বিনা পয়সায় চাকরি। খরচ মাত্র ১৩৫ টাকা। এ যেনো আকাশ কুসুম কল্পনা। অনিকার বাবা বাবুল মিয়া পেশায় গাড়িচালক।
বাবুল মিয়া আবেগে অনেকটা অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, ‘এতদিন জানতাম সরকারি চাকরি পেতে টাকা লাগে। এবারই প্রথম দেখলাম চাকরি পেতে এক টাকাও লাগে না। এমন নিয়োগ প্রক্রিয়া জীবনে প্রথম দেখলাম। ’
সাধারণ কোটায় মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন জৈন্তাপুরের বাউরবাগ কান্দি গ্রামের রহমত উল্লাহর ছেলে মো. দুলাল আহমদ। পেশায় কৃষক বাবার সন্তান দুলাল বলেন, নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি ঠিকই, তবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণেই অবহেলিত পরিবারের সন্তান হয়েও পুলিশে চাকরির সুযোগ হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মেধা তালিকায় ১১তম অর্জনকারী সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাকারিয়া বলেন, ‘আগে ভ্রান্তধারণা ছিল পুলিশে চাকরি পেতে টাকা লাগে। সেই ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ’ মেধা তালিকায় ১৯তম হওয়া জকিগঞ্জের লিটন বিশ্বাস ও ৩০তম স্থান অর্জনকারী ওসমানীনগরের আব্দুল আজিজ বলেন, ‘টাকা না দিলে চাকরি হবে না, আগে শুনতাম। কিন্তু নিজেদের মধ্যে পণ ছিল-টাকা লাগলে চাকরি করবো না। সেই ধারণা ভুল। টাকা নয়, বরং পুলিশে চাকরি নিতে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারাটা আসল। ’
২ নভেম্বর সিলেট জেলায় পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়া হয়। পরীক্ষার সাতটি ধাপ সম্পন্নের পর ৭২ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের চূড়ান্ত মেডিক্যাল পরীক্ষা বুধবার (১৮ নভেম্বর) ঢাকায় হওয়ার কথা রয়েছে।
কনস্টেবল পদে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়ে পুলিশ বিভাগের জন্য নতুন মাইলফলক বলে মনে করছেন সিলেটের মানুষ।
পিআরবি আইনের নতুন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পদ্ধতি প্রসংশিত হচ্ছে সিলেটের মানুষের কাছে। এ যাবত নিয়োগের বিষয় নিয়ে আঙ্গুল তুলতে পারেননি কেউ। স্বচ্ছতার কাছে এবার রাজনৈতিক সুপারিশ এবং দালাল, প্রতারকচক্রও অপতৎপরতা ভেস্তে গেছে।
এ বিষয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ব্রিটিশ আমলের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) নীতিমালা অনুসারে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হতো। এবার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আইজিপি নিয়োগবিধিতে পরিবর্তন এনেছেন। আগে কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া একদিনেই সম্পন্ন করা হতো। ফলে ইথিক্যাল দিকগুলো নামেমাত্র হতো। বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে পরদিন ফলাফল দিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়ায় এবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। নীতিমালা সংশোধন করেছেন পুলিশ প্রধান। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ছিল নকআউট পদ্ধতিতে। সাতটি ধাপ পেরিয়ে সিলেক্টেড হয়েছেন ৭২ জন। তারা নিজেদের চাকরির যোগ্য প্রমাণ করতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, আবেদনকারীদের মধ্য থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে বাছাইয়ে ২ হাজার ৮৮০ জনকে মাঠে আনা হয়। এখান থেকে শারীরিক যোগ্যতা যাচাইক্রমে লিখিত পরীক্ষায় ৫১৮ জনকে আহ্বান করি। এর থেকে লিখিত পরীক্ষায় ১৭১ জন উত্তীর্ণ হয়। এদের মধ্যে থেকে ৭২ জনকে নিয়েছি। এই ৭২ জনের মধ্যে ৫৭ জন কৃষক পরিবারের সন্তান। যাদের পরিবারে কোনো সরকারি চাকরিজীবী নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় তারা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে ৬ জন নারী সদস্য রয়েছেন।
এবার সারা দেশে ১৮ লাখ আবেদন পড়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চতা এবং বাছাইয়ে সারা দেশে এক লাখ ৩০ হাজার জনকে মাঠে আহ্বান করা হয়। প্রথম দিনই সিলেটে তুলনামূলকভাবে ভালো ছেলেগুলোকে মাঠে ডাকা হয়। প্রথম দিন বাছাইয়ে পর ২৮ সেকেন্টে ২শ মিটার দৌড়, মেয়েদের ৬ সেকেন্ডে একটু বেশি ছিল। প্রথম দিন উত্তীর্ণদের নিয়ে লং ও হাই জ্যাম্প ও পুশডাউন বা বুকডন করানো, পরের দিন সাড়ে ৬ মিনিটে ১৬শ মিটার দৌড় ছেলেদের এবং মেয়েদের জন্য ১ হাজার মিটার ছিল ৬ মিনিটে। যারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তারা বাদ পড়েছেন।
এছাড়া সক্ষমতা যাচাইয়ে ৭৫ কেজি ওজনের ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যারা এই ধাপগুলো শেষ করতে পেরেছে, তাদের লিখিত পরিক্ষার জন্য কার্ড ইস্যু করা হয়। এরপর ঢাকা থেকে প্রশ্নপত্রে কোডিং পদ্ধতিতে খাতা চলে যায় ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে। সেখান থেকে ফলাফল এলে মিলিয়ে দেখা হয় কে কত নম্বর পেলেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মৌখিকে ডাকা হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে টিমও নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। নিয়োগ বোর্ডে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ২ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছাড়াও পরীক্ষার ইভেন্টগুলো পরিচালনায় ছিলেন ১৪৫ সদস্য।
৭টি ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। আর যারা আগে দালালি, বাটপারি করতো, তারাও বুঝে গেছে, আর অনিয়ম করার সুযোগ নেই। মানুষকে এই মেসেজটা দেওয়া দরকার, আমরা সফলতার দিকে যাচ্ছি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লুৎফর রহমান বলেন, পুলিশে চাকরি নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। অনেকে ধারণা করে থাকেন। কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে আইজিপির বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এর ফলে বিভিন্ন ধাপে পরীক্ষার্থীদের নিজ যোগ্যতা ও মেধায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এখানে প্রতারণা বা বায়েস্ট করার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে পুলিশের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি গ্রহণ করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট জেলায় পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সিলেটের জৈন্তাপুরে ১১ জনের মধ্যে সাধারণ কোটায় ৬ জন, মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার ভিডিপি কোটায় ২ জন করে এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী একজন। গোয়াইনঘাটে ২৫ জন। এরমধ্যে সাধারণ কোটায় ১৬ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৬ জন, নারী কোটায় ২ জন এবং এতিম কোটায় একজন নিয়োগ পেয়েছেন। ওসমানীনগরে সাধারণ কোটায় ৩ জন। কানাইঘাটে সাধারণ কোটায় ৬ জন। জকিগঞ্জে ৭ জনের মধ্যে সাধারণ কোটায় ৩ জন, মুক্তিযোদ্ধা ও নারী কোটায় একজন করে এবং আনসার-ভিডিপি কোটায় ২ জন। সিলেট সদরে ১২ জনের মধ্যে সাধারণ কোটায় ৮ জন, মুক্তিযোদ্ধা, আনসার-ভিডিপি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং নারী কোটায় একজন করে চাকরি পেয়েছেন। গোলাপগঞ্জে সাধারণ ও আনসার-ভিডিপি কোটায় একজন করে। কোম্পানীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় একজন করে। দক্ষিণ সুরমায় নারী কোটায় একজন, বিশ্বনাথে সাধারণ ও নারী কোটায় একজন করে এবং বালাগঞ্জে পুলিশের পোষ্য কোটায় একজনকে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২১
এনইউ/এএটি