ঢাকা: ‘সমুদ্র বড়ই রহস্যময়, আবহাওয়া এই ভালো তো এই খারাপ। এর ভাব-গতি বোঝা বড় দায়।
খাল, নদী পেরিয়ে মাছ ধরতে সমুদ্র বিচরণের যত অভিজ্ঞতার কথা বাংলানিউজকে এভাবেই বলছিলেন- মো. আব্দুল হাই ওম। মাছ ধরে সমুদ্র থেকে আগের দিন সন্ধ্যায় রওয়ানা করে সকালে দুবলার চর ঘাটে এসেছেন তিনি। সারা রাত বোট চালিয়ে ক্ল্যান্ত, পরিশ্রান্ত থাকার পরও এই প্রতিবেদককে বলছিলেন তার অনেক কথা। তার সঙ্গে বোটের সঙ্গী ছিলেন জেলে নজরুল ইমলাম।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার পদ্মপুকুর গ্রাম থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে গফুর সরদারের শুটকির সাবারে কাজ করতে এসেছেন মো. আব্দুল হাই ওম। মাছ ধরা এবং সেগুলো বোটে করে নিয়ে আসা তার নিত্যদিনের কাজ। সুন্দরবনের খাল বেয়ে সমুদ্রে, আবার কুল-কিনারবিহীন থেকে সমুদ্রে পথ খুঁজে খাল বেয়ে দুবলার চরে ফিরে আসতে কোনো ভয় নেই তার। আবহাওয়ার আভাস অনুকুলে না প্রতিকূলে সবকিছু বিবেচনা করে বিশাল এই জলরাশিতে রাত-দিনভর আব্দুল হাই ওমর বিচরণ।
নৌপথে চলাচলের প্রধান উপকরণ দিগদর্শী বা কম্পাস নেই আব্দুল হাই ওমেও বোটে। তবে চলতে চলতে তার পথ নির্ণয় ও অনুভব শক্তি যেন প্রখর হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তিনি খাল-নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরার কাজটি করছেন। সূর্য ও তারার মাধ্যমেও তিনি দিকনির্ণয় করে বোট চলান তিনি।
আব্দুল হাই ওম বলছিলেন, মাছ ও শুটকি সাবারে আমরা ১৩ জন এসেছি। নদী সমুদ্র থেকে মাছ ধরা আর শুটকি তৈরির জন্য। সমুদ্রে আমাগের একটি বোট আছে, সেখানে ৫/৬ জন জেলে আছে। তারা মাছ ধরে। মাছ নিয়ে আপ-ডাউনের (মাছ আনতে) জন্য একটি আমার বোটে দুইজন, আমি ও সঙ্গে মজিবুর রহমান। পারে (দুবলায়) থাকে ৫/৬ জন। তারা মাছ নেয় আর শুটকি তৈরি করে। আমরা মহাজন গফুর সরদারের সঙ্গে মোট ১২/১৩ জন কাজ করছি।
বোটে কোনো কম্পাস নেই? কীভাবে পথ খুঁজে পান? জানতে চাইলে আব্দুল হাই বলেন, ‘দিনে চলতে হয় মনের আন্দাজে আর রাতে চলতে হয় আকাশের তারা দেখে। সুন্দরবনের খাল বেয়ে বের হতে থাকি। তখন আকাশে দক্ষিণের তারা আর উত্তরের তারা দেখে দিক ঠিক করা লাগে। তখন অনুভব করি, দক্ষিণের তারা যদি ওই হয় আর উত্তরের তারা যদি এই হয়, তাহলে আমাগের যাতি হবে পশ্চিমে। যখন খাল থেকে সমুদ্রে উঠি, তখন অনুভব করতে হয় উত্তরের বাতাস আছে কিনা? কারণ উত্তরের বাসাত আমার ডান পাশের কানে লাগলে বুঝি যে আড়ে (সঠিক) যাচ্ছি। আমারা নমুনায় তখন পথ খুঁজে পাবো। সমুদ্রে মাঝে গিয়ে আমাদের মিউজিক বাতি চলতে দেখলে বুঝি আমরা গন্তব্যে এইসেছি। আর দিনের বেলায়, যখন যাই, তখন পুরো মনের আন্দাজে চলতে হয়। রাতে চলাচলে বেশি সুবিধা হয়। ’
‘কখনও পথ হারিয়ে যায়। চলার মধ্যে যদি মনে হয় আমি দিক হারিয়ে ফেলেছি, তখন জোয়ার ভাটা নির্ণয় করতে হয়। বোট চালাতি গেলে জোয়ার-ভাটা ভালো বুছতে হবে। এটাই আসল। তখন বোট বন্ধ করে নোঙ্গড় ফেলি। দেখি জোয়ার কোনদিকে যাইচ্ছে। তখন জোয়ারের পথ ঠিক করি। এভাবেই আমরা পথ ঠিক করি’ -যোগ করেন তিনি।
‘দিন-রাত আমরা মাছ ধরি। যখন সময় পাই, তখন ফুনে (মোবাইল ফোন) আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা বলি, বাড়িতে বৌ-বেটির সঙ্গে কথা বলি। আগে দুবলায় কোনো নেটওয়ার্ক ছিল না। এখন টেলিটক আছে। তাই বাড়ির খবর নিতে পারি। পুরো মৌসুমে মালিক দুইবার ছুটি দেয়। দুইবার বাড়ি যেতে পারি। কদিন থেকে আবার চলে আসি।
জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া এবং বেঁচে আসার একটি গল্প শোনালেন আব্দুল হাই। তিনি বললেন, ‘একবার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলাম। বোটে আমরা পাঁচজন জেলে ছিলাম। সমুদ্রে জাল ফেলে মাছ ধরছি। নৌকা ভাসতে ভাসতে শ্রোতের মধ্যে পড়ে গেল। পানি টানতে টানতে মাঝের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। আমরা কি করবো, দিশে পাচ্ছিলাম না। একটা সময় নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে। কী করি! তখন আমরা সবাই ভাবলাম, কুল হারা এই সাগর থেকে বাঁচতি হবে। তখন নৌকায় দুটো ড্রাম ছিল। ৩০ লিটার করে এক একটি। আর একটি বড় কাঠ নিয়ে দুটি ড্রাম দুই মাথায় বেধে পানিতে ভাসিয়ে দিলাম। এরপর আমরা ৫ জন্য ওই কাঠের ওপর বসে ভাসতে থাকলাম। আমাগের বোট পানিতে ডুবে গেছে। তখন পানিতে ভাসছি। মনে বড় ভয় হচ্ছিলো, এই বুঝি হাঙ্গর পায়ে কামড়ে ধরলো। তবুও আল্লাকে ডাকতে থাকলাম। কোনো কুল কিনারাও দেখা যাচ্ছিলো না। খালি পানি আর পানি। পরে চট্টগ্রামে একটি ফিসার বোট আমাদের ভাসতে দেখে কাছে আছে। পরে তারা আমাগের টেনে তাদের বোটে তোলে। আমরা একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি ভাই।
জেলে আব্দুল হাই ওমের পরিবারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে (৯) ও ছোট মেয়ের বয়স (৫) বছর। সংসার চলে খুব কষ্টের মধ্যে। এখন কিছুই থাকে না। দুর্ঘটনায় হাতের তিনটি আঙুল পড়ে যাওয়ার কারণে তার চিকিৎসায় অনেক টাকা লেগে যায়। এতে তার আগের মহাজন শহীদ গাজী তাকে ৫ হাজার টাকা সহায়তা করেছিলেন। বাকি টাকা তিনি সুদে নিয়েছিলেন। সেই টাকার সুদ এখনও তিনি দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ওম।
ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, স্বচ্ছলতা ফিরবে, এমন আশা নিয়ে প্রতি মৌসুমেই জেলেরা ছুটে আসেন সুন্দরবনের দুবলার চরে। ডেড়া বাঁধেন, এরপর শুরু হয় নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরা। নাঁওয়া-খাওয়া ভুলে রাত-দিন খাল, নদী আর সমুদ্রে বুকে ভেসে বেড়ায় জেলেরা। বোট থেকে জাল ফেলেই নিজে কিসমতের কপালে হাত বুলায়। একটি বড় মাছ পাওয়ার জন্য ওপরের দিকে তাকিয়ে শতবার, হাজারবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকেন জেলেরা। কখনও মিলে আবার কখনও মিলে না। তবুও আশার আলো খুঁজতে আকাশের তারা দেখে পথ চলেন জেলেরা।
মোংলা উপজেলার চাদপাই ইউনিয়নের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে বিচ্ছিন্ন দুবলার চর। এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল জুড়ে টানা ৫ মাস চলে শুটকি তৈরির কর্মযজ্ঞ।
সুদের ফাঁদে জিম্মি জেলে
‘কামাল সাহেবের’ ইচ্ছায় চলে দুবলার চর
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২১
এসজেএ/এসআইএস