ঢাকা: ঢাকা জেলাধীন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয় বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি মামলার বিচারকাজ।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১১২ শ্রমিক।
ওই অগ্নিকাণ্ডে স্বজন হারানো ব্যক্তিদের কান্না যেন থামছেই না। দেশের ইতিহাসে এ ঘটনা অন্যতম ভয়াবহ ট্রাজেডি হলেও বিচার নিয়ে রয়েছে ধীরগতি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, খুব দ্রুতই বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে।
অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন।
২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল।
এই ১৩ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক ও একজন কারাগারে। সবশেষ ২৪ অক্টোবর মো. শহিদুজ্জামান দুলাল আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই আছেন। মোবারক হোসেন মঞ্জু, মো. রানা ওরফে আনারুল, মো. শামিম মিয়া ও আল আমিন পলাতক। দেলোয়াসহ বাকি ৮ আসামি জামিনে রয়েছেন।
চার্জশিট দাখিলের পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটি এখন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলারা আলো চন্দনার আদালতে বিচারাধীন। বিচার শুরুর ছয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণে অগ্রগতি খুব সামান্য। রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর জরিনা বেগম নামে এক আহত শ্রমিক আদালতে সাক্ষ্য দেন। আগামী ১৮ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
বিচারে এই ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর রেহানা আক্তার বলেন, করোনায় দীর্ঘ সময়ে আদালত বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। করোনা পরবর্তী সময়ে মামলায় একজন শ্রমিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার অধিকাংশ সাক্ষীই তাজরীন ফ্যাশনের শ্রমিক। যারা অগ্নিকাণ্ডের পর ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এসব সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানাও নেই। এ কারণে তাদের খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে সাক্ষীদের খোঁজ করার চেষ্টা করছি। যে শ্রমিক সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন তিনিও সাক্ষীদের বের করতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। শ্রমিকদের সাক্ষ্য শেষ হলে পুলিশ সাক্ষী হাজির করে যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির বিচার শেষ করার চেষ্টা করবো।
মামলার এই ধীরগতি নিয়ে অসন্তুষ্ট আসামিপক্ষও। আসামিপক্ষের আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, মামলায় নিয়মিত সাক্ষী হচ্ছে না। সাক্ষী আসুক বা না আসুক আসামিদের তো নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে। এতে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, মামলার অনেক আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। আসামি দুলাল উদ্দিন ঘটনার দিন সেখানে ছিলেন না। অন্য দুলালের জায়গায় তাকে আসামি করা হয়েছে। সিকিউরিটি গার্ড আল আমিনের স্ত্রীও সেখানে কাজ করছিলেন। কারো স্বজন যদি ভেতরে থাকলে তিনি কি বের হতে বাধা দেবেন? পুলিশ ডেকে এনে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা বলে অনেককে আসামি করেছে। তারা নিজেরাও তো ভিকটিমাইজড। ’
তাজরিন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী বলেন, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। কারণ তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও তাকে মামলায় জড়িত করা হয়েছে। তার দুই থেকে আড়াইশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য সহযোগিতা করছে। তারপরও তাকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১২ পোশাক শ্রমিক মারা যান। আহত হন ১০৪ জন। গার্মেন্টস কারখানাটিতে এক হাজার একশ ৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। নিহত ১১১ জনের মধ্যে তিনতলায় ৬৯ জন, চারতলায় ২১ জন, পাঁচতলায় ১০ জন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। মরদেহ শনাক্ত হওয়ায় ৫৮ জনকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৫৩ জনের মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় তাদের অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানায় এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের নামে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়।
মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক একেএম মহসীনুজ্জামন। ভবনটির নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমণের পথ থাকায় থাকায় শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপন মহড়া বলে কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেয় বলেও চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২১
কেআই/এএটি