খুলনা: খুলনায় দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। গ্রুপ করে খুন, মাদক চোরাচালান, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ইভটিজিং, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অনেক পাড়া মহল্লায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কিশোর গ্যাংয়ের দলবদ্ধ বেপরোয়া আচরণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে। এরা বিভিন্ন নামে নানা ধরনের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব অপরাধে। সন্তান বখাটে হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য পরিবারে অশান্তি বিরাজ করছে।
আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কিশোর গ্যাংয়ের ইন্ধনদাতাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব-৬ এর বিশেষ টিম।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) র্যাব-৬ এর অভিযানে খুলনা মহানগরীর একটি বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের ১০ জন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এই কিশোরেরা “কিং অব রূপসা” নামে পরিচিত। আটককৃত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিকট হতে নেইল কাটার, চিমটা, চাকু, মোবাইলফোন, সিগারেট, মানিব্যাগ, টর্চ লাইট, ব্রেসলাইট, লাইটার, গাড়ির চাবি, মোটরসাইকেল-০৩টি এবং নগদ টাকা উদ্ধার করে।
সদর কোম্পানির একটি অভিযানিক দল মহানগরীর রূপসা ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের এ সদস্যদের আটক করে। পরে তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই কিশোরেরা “কিং অব রূপসা” নামে পরিচিত। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানায় তাদের “কিং অব রূপসা” নামের গ্রুপে ২০-২৫ জন সদস্য আছে। এরা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। তারা পেশাগতভাবে কেউ কেউ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, কেউ কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ড্রপ আউট, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী। কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের কিশোর অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবনসহ ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে ছিনতাই, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও বিভিন্ন সমগোত্রীয় গ্রুপের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ব স্থাপন করা। শুধু তাই না এরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাদের নিজেদের বাবা-মাকেও হেনস্থা করতে পিছপা হয় না। এলাকায় স্থানীয় মুরব্বী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন তো করেই না, বরঞ্চ ক্ষেত্রমতে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমান করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে চলতি মাসের রোববার (৭ নভেম্বর) মহানগরীর পুরাতন স্টেশন রোড, ৭নং ঘাট ও নিরালা এলাকা থেকে ১২ জন কিশোর ও একজন কিশোরীকে আটক করে র্যাব-৬। তারা মাদকাসক্ত হয়ে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ও ধারালো চাকু উদ্ধার করা হয়।
৩০ অক্টোবর রাতে মহানগরীর রূপসায় সপ্তম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনায় চয়ন ব্যাপারী নামের এক কিশোর গ্যাংয়ের হোতাকে গ্রেফতার করে র্যাব। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত চয়ন ব্যাপারীর নিয়ন্ত্রণে রূপসা স্ট্যান্ড রোড থেকে বান্ধাবাজার, চানমারী, রূপসা সেতু পর্যন্ত কয়েকটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। তাদের ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
মহানগরীর চানমারী বাজার এলাকায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় মো. আল ফায়েদ (১৭) নামের নবম শ্রেণির স্কুলছাত্র নিহত হয়। একই সময় ছুরিকাঘাতে আহত হয় শুভ (১৮) নামের আরেক স্কুলছাত্র। এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে বিবাদে দফায় দফায় সংঘর্ষে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর নগরীর সোনাডাঙ্গায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শহিদুল ইসলাম রাসেল (১৮) নামে এক যুবক নিহত হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর রূপসা বাগমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের গুপ্তির আঘাতে (দুই দিকে ধারালো ছুরি) সারজিল ইসলাম সংগ্রাম (২৬) নিহত ও ২৩ সেপ্টেম্বর নগরীর সোনাডাঙ্গা মজিদ সরণি এলাকায় সুজুকি মোটরসাইকেল শোরুমের সামনে মহিদুল ইসলাম নামে আরেক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর অপরাধীরা।
অনুসন্ধানীতে জানা গেছে, নগরীর সাত রাস্তার মোড়, লবণচরা, শিপইয়ার্ড এলাকা, বান্দাবাজার, খুলনা পাবলিক কলেজ এলাকা, মডেল স্কুল এলাকা, শ্মশানঘাট, পিএমজি স্কুল এলাকা, আফজালের মোড়, খুলনা রেলস্টেশন এলাকা, ৭ নম্বর ঘাট, রূপসা স্ট্যান্ড রোড, নিরালা আবাসিক, চানমারী বাজার, মোক্তার হোসেন সড়ক, পালপাড়া, বয়রা বাজার ও পূর্ব রূপসা বাগমারাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রভাব বিস্তার ও মাদক বেচাকেনায় এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং তৈরি করা হচ্ছে।
র্যাব-৬ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমদ জানান, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এই কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার লক্ষ্যে র্যাব-৬ এর একটি চৌকশ আভিযানিক দল সাদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। যারা আটক হয়েছে তারা অনেক তথ্য দিয়েছে। র্যাবের কাছে বিভিন্ন এলাকার এ রকম কিশোর গ্যাং সম্পর্কে আরও তথ্য রয়েছে। যা পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অনুশাসন কমে যাওয়া, বর্তমানের শিশু-কিশোররা ইউটিউব, ভায়োলেন্ট গেমস, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। পুলিশের কঠোর নজরদারি এবং পরিবারের নজরদারি ও মূল্যবোধ দিয়ে কিশোর অপরাধ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিউল হক বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো মানুষ যখন কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সেই অপরাধকে কিশোর অপরাধ বলে। ‘কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি’ কিশোর অপরাধের একটি নতুন দিক। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশ কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। খুলনায়ও যার বিস্তৃতি লাভ করেছে। এতে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে।
কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মা-বাবা উভয়ে ঘরের বাইরে কাজ করছেন। ফলে সন্তান তাদের উপযুক্ত স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, নিত্যদিনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে ব্যর্থ, অসৎ সঙ্গ, মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ, মা-বাবার সঙ্গে কিশোর সন্তানদের দূরত্ব তৈরি, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ নানা কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে।
এ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সামিউল হক বলেন, কিশোর গ্যাং তৈরি হওয়া বন্ধে প্রথমে মা-বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে। এ বিষয়গুলো পর্যাপ্ত মনিটর করতে হবে। কিশোর গ্যাং বন্ধে মা-বাবার যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি শিক্ষকসহ সমাজের প্রত্যেক মানুষের ভূমিকা রয়েছে। তারা সবাই যে যার স্থান থেকে চেষ্টা করলে বন্ধ হয়ে যাবে কিশোর গ্যাং কালচার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২১
এমআরএম/এজে