ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সম্মুখ লড়াইয়ের বীর খায়রুল জাহান 

নজরুল ইসলাম খায়রুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
সম্মুখ লড়াইয়ের বীর খায়রুল জাহান  শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহানের স্মৃতিস্তম্ভ

কিশোরগঞ্জ: একাত্তরের ২৬ নভেম্বর সকাল। অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান কয়েকজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প দখল করার সিদ্ধান্ত নেন।

চরপুমদী বাজারের রাজাকার ক্যাম্প থেকে এক রাজাকার শহরের ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে এ খবর পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে শত শত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মিলে ঘিরে ফেলে সদর উপজেলার প্যাড়াভাঙ্গা এলাকায় অবস্থানরত খায়রুলসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে। ভোরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্য খায়রুল জাহান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে থাকেন শত্রুপক্ষের ওপর। সহযোদ্ধাদের অধিকাংশই তখন অক্ষত অবস্থায় সরে যেতে পারলেও শত শত পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে খায়রুলের। একপর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছোড়া গুলিতে শহীদ হন খায়রুল জাহান।  

দেশমাতৃকার জন্য খায়রুলের এ আত্মোৎসর্গের দিন ২৬ নভেম্বর। বরাবরের মতোই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় এ বীরকে।

মুক্তিযুদ্ধের নথি ঘেঁটে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খায়রুল জাহান জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার লতিফপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত তালুকদার বাড়িতে। ছোটবেলা থেকে খায়রুল জাহান ছিলেন সাহসী। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন তিনি। বাড়ির পাশের লতিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পড়াশোনা করে ১৯৬৭ সালে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় হতে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন খায়রুল। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পরীক্ষা দিয়ে মনোনীতও হয়েছিলেন। পরে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য চিঠি আসে মার্চ মাসের ২৭ তারিখ। কিন্তু তখন পাকিস্তানি সেনারা মেতে উঠেছে বাঙালি হত্যাযজ্ঞে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা সঠিক মনে করলেন খায়রুল জাহান। কিশোরগঞ্জের মুক্তিকামী তরুণ-যুবকদের সংঘটিত করে খায়রুল জাহান বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন ৭ জুন।

ভারতের মেঘালয়ে মেজর এটিএম হায়দারের অধীনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। নভেম্বরে চলে আসেন গ্রামের বাড়ি লতিফপুরে। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। পরে কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে রাজাকারদের ওই ক্যাম্প দখল করার সিদ্ধান্ত নেন খায়রুল ও তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু ২৬ নভেম্বর ভোরের সেই যুদ্ধে খায়রুলের পাশাপাশি শহীদ হন সেলিমসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ৭-৮ জন পাকিস্তানি সেনাও নিহত হয়। লড়াইয়ের পর খায়রুল জাহানের নিথর মরদেহ গাড়িতে করে শহরের দিকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। পরে আর খায়রুল জাহানের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।  

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহানকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে এবং তার স্মরণে প্যাড়াভাঙ্গায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে।

দীর্ঘদিন পর মুক্তিযুদ্ধকালে খায়রুল জাহানসহ বাঙালি গণহত্যায় জড়িত রাজাকারদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার হোসেনসহ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে।  

৪৮ বছর আগে ভাইকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে এখনো আবেগী হয়ে পড়েন শহীদ খায়রুল জাহানের ভাই সাদেকুজ্জাহান তালুকদার নয়ন। তিনি ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান।

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান বীরপ্রতীকের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হযরত আলী মাস্টার বলেন, ‘২৬ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের কাছাকাছি রাজাকারদের একটি ক্যাম্প দখল করার প্রস্তুতি নিই আমরা। কিন্তু কেউ একজন পাকিস্তানি বাহিনীকে খবরটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে রাতেই প্যারাভাঙ্গা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০-৩৫ জনের দলটিকে ঘিরে ফেলেছিল কয়েক শত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা। ভোর থেকে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। জয়ের সম্ভাবনা না দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান (বীরপ্রতীক) মেশিনগান নিয়ে রাস্তায় উঠে গুলি করতে করতে শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখেন আর চিৎকার করে আমাদের পালিয়ে যেতে বলেন। এক সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। কিন্তু তাদের হাতে ধরা দেননি। এর আগেই গ্রেনেড চার্জ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তার জীবনের বিনিময়ে সেদিন প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে রক্ষা পান। ওই যুদ্ধে খায়রুলসহ আরও চার-পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীনের পর তৎকালিন সরকার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহানকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে এবং একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। স্থানীয়ভাবে সীমিত পরিসরে প্রতি বছর ২৬ নভেম্বর প্যাড়াভাঙ্গায় স্থাপিত খায়রুল জাহানের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়াও তার স্মরণে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
  
দীর্ঘদিন পর শহীদ খায়রুল জাহানসহ গণহত্যায় জড়িত রাজাকারদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ হোসাইননসহ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় এখনও কার্যকর হয়নি।  

শহীদ খায়রুল জাহানসহ গণহত্যায় জড়িত রাজাকারদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও শহীদ খায়রুল জাহানের পরিবারসহ স্থানীয় এলাকাবাসী।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।