ঢাকা: সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনায় জড়িত চালকদের কেউই পেশাদার বা করপোরেশন নির্ধারিত চালক নয়।
জড়িত চালকদের গ্রেফতারের পর জানা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং ওয়ার্কশপের সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। এ সুযোগে তারা ময়লাবাহী গাড়ি চালানোর সুযোগ পায়। এজন্য তাদের কোন বেতন ছিল না, প্রতিদিন গাড়ির জন্য বরাদ্দ করা তেল থেকে ১৭-২০ লিটার তেল বিক্রি করাই ছিল তাদের উপার্জন।
২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লবাহী গাড়ির ধাক্কায় নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে চালক রাসেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ, যিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পরে শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে মূলচালক হারুনকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)।
গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীর পান্থপথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় সংবাদকর্মী আহসান কবীর খাঁন (৪৬) নিহত হন। এ ঘটনায় শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) চাঁপুরে অভিযান চালিয়ে চালক হানিফ ওরফে ফটিককে গ্রেফতার করে র্যাব-২।
র্যাব জানায়, ঘটনার দিন হানিফ পান্থপথ থেকে গাবতলীতে দুইবার ময়লা নিয়ে ডাম্পিং করে। তৃতীয়বার যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেলকে চাপা দিলে আরোহী আহসান কবীর নিহত হন। ঘটনার পর ভয় পেয়ে হানিফ ও তার সহকারী কামরুল (১০) গাবতলী ভয়ে পালিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে চাঁদপুরে নানার বাড়িতে আত্মগোপণে যায় হানিফ।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২ হানিফকে ধরতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। এরপর চাঁদপুর থেকে হানিফকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতার হানিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, তিনি গত ৬-৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্কশপে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ডিএনসিসির বেতনভুক্ত বা দৈনিক মজুরিভিত্তিকও কর্মচারী না। প্রতিদিন মেকারের সহকারী হিসেবে কাজ করলে কেউ যা বকশিশ দিতো, সেটাই তার একমাত্র আয় ছিল। এর মধ্যে গত ৩ বছর ধরেই তিনি ডিএনসিসির বিভিন্ন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ১৯ সালে নিজে হালকা যানবাহন পরিচালনার লাইসেন্স পেলেও ময়লাবাহী ট্রাকের মতো ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না। এরপরেও গত প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি এই ময়লাবাহী ভারী ট্রাক চালাতেন।
গত কয়েক বছরে সিটি করপোরেশনের কয়েকজনের সঙ্গে তার সখ্যতা হয়। সেই সখ্যতা থেকেই তিনি গাড়ি চালানোর জন্য পেয়ে যান। এজন্য তিনি কোন মাসিক বা দৈনিক হাজিরার বেতন পেতেন না। তবে গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল থেকে প্রতিদিন ১৭-২০ লিটার তেল বাঁচাতে সক্ষম হতেন তিনি। সেই তেল বিক্রির অর্থই ছিল তার আয়ের উৎস।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হানিফ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের কাছে ২-১ জনের কথা বলেছে। যাদের সঙ্গে সখ্যতার জেরে সে গাড়িটি চালানোর জন্য পায়। এর মধ্যে ডিএনসিসির স্থায়ী কর্মী এবং মাস্টাররোলের কর্মীও রয়েছে। আমরা বিষয়গুলো যাচাই বাছাই করতে ডিএনসিসির সঙ্গে আলোচনা করবো। তারা নিশ্চই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
এছাড়া এ ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতার হানিফকে থানায় সোপর্দ করা হবে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও নিশ্চই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবেন।
নটরডেম শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়িচালক গ্রেফতার হারুনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হারুন গত দেড় বছর ধরে হারুন গাড়িটি চালালেও তার নামেও গাড়িটি বরাদ্দ নয়। সেও মূল চালক নয়, তার কাছে আমরা লাইসেন্স পাইনি। ঘটনার দিন তিনি অসুস্থ ছিল বলে দাবি করেছে, তাই রাসেলকে সেদিন চালাতে দিয়েছিল বলে জানিয়েছে।
কিন্তু সেদিন ছাড়াও রাসেলকে মাঝেমধ্যে গাড়ি চালাতে দিতেন হারুন। রাসেল যখন অ্যাক্সিডেন্ট করে তখন অন্যদের মাধ্যমে খবর পায়। পরে তিনি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তিনিও গাড়ি চালনোর জন্য ডিএসসিসির কাছ থেকে কোন বেতন পেতেন না। বেচে যাওয়া তেল বিক্রিই তার একমাত্র আয় ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতাররা জানেনা গাড়িগুলো কার নামে বরাদ্দ। তবে হানিফের কাছ থেকে আমরা ২-১ জনের নাম পেয়েছি। বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাবো। তারা হয়তো এ বিষয়ে বলতে পারবে। প্রতিদিন গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল পুরোটা খরচ হয়না, বেচে যাওয়া তেল বিক্রি করেই তাদের আয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তাও এ বিষয়ে তদন্ত করবে। আশা করছি, যে ধরনের অপসংস্কৃতি চলে আসছে, আমরা এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২১
পিএম/এএটি