লালমনিরহাট: সরকারি কোয়ার্টারে ফ্রিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের রাজস্ব বাড়াতে দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেন রংপুর বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম লেলিন।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে বাংলানিউজকে মোবাইলে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ আশ্বাস দেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) বাংলানিউজে ‘কাকের বাসায় কোকিলের বাস! রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জাকিরুল ইসলাম লেলিন বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি কোয়ার্টারে ফ্রিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। অনেক সময় ডরমেটরি ঘোষণা করে ডমনেটারির ভাড়ায় থাকার কথা শুনেছি। তবে ফ্রিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। খুব দ্রুত সরেজমিনে তদন্ত করে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। কোনো অনিয়মকে বরদাস্ত করা হবে না।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন সময় এ হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। চিকিৎসকদের শতভাগ উপস্থিতি পেয়েছি এবং তারা সবাই হাসপাতাল চত্বরেই থাকেন। তবে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে থাকার বিষয়টি জানা ছিল না। এখন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম লেলিন আরও বলেন, আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও অবসের চিকিৎসকের অভাবে তা বন্ধ রয়েছে। খুব দ্রুত সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক পদায়ন করে অপারেশনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাতে করে তিস্তা চরাঞ্চলের মায়েরা প্রসবকালীন সময় হাতের কাছে ফ্রিতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সিজারের সুবিধা পান।
অনিয়ম তুলে ধরে সরকারের রাজস্ব বাড়াতে সংবাদ প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষের নজরে নিয়ে আসার জন্য বাংলানিউজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে জাকিরুল ইসলাম লেলিন বলেন, রাজস্ব না বাড়লে সরকারি সেবা পৌঁছানো সরকারের জন্য কষ্টকর। তাই রাজস্ব বাড়াতে হবে। তথ্য অধিকার আইনে তথ্য না দেয়াটা দুঃখজনক। সব বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, আদিতমারী উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করে সরকার। রোগীদের চাপ বিবেচনা করে পরে তা ৫০ শয্যায় উন্নতি করা হয়। সেই অনুযায়ী নতুন ভবনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য ২০-২৫টি ফ্যামিলি কোয়ার্টারও নির্মাণ করা হয়।
সরকারি বাসা বরাদ্দ নিলে বেতনের একটা অংশ বাসা ভাড়া হিসেবে বেতন থেকে কাটা হয়। সে ক্ষেত্রে বেতন বেশি হলে বাসা ভাড়াও বেশি কাটা হয়। বাসা ভাড়া হিসেবে কাটা অর্থ সরাসরি সরকারের কোষাগারে জমা হয়। যারা ফ্রিতে থাকেন, তারা এ টাকা দেন না। তবে এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যে খুশি রাখতে কিছু টাকা গুণতে হয়।
সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে কতিপয় কর্মকর্তা তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নামে বাসা বরাদ্দ নিয়ে নিজেরা বসবাস করেন। বরাদ্দ গ্রহণকারী কর্মচারীর যে পরিমাণ অর্থ কেটে নেওয়া হয়, তা বসবাসকারী কর্মকর্তা ওই কর্মচারীকে নগদে প্রতিমাসে দেন। এভাবে মোটা অংকের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো কোয়ার্টার সরকারি খাতায় শূন্য দেখানো হলেও বাস্তবে ভাড়ামুক্ত ফ্রিতে বসবাস করেন সরকারি কর্মকর্তারা। এমনকি সরকারি কাজে আসা অস্থায়ী কর্মকর্তাদের বিশ্রামের জন্য নির্মাণ করা ডরমেটরিতে কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এতেই শেষ নয়, নিজ এলাকায় কর্মরত থাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) নামেও বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বাসায় থাকেন চিকিৎসকরা। সিএইচসিপিদের বেতন স্কেল আর চিকিৎসকদের বেতন স্কেলের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সব মিলে এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টার বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিলেও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে মাঝে মধ্যে টাকা গুণতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন হাসপাতালের কোয়ার্টার ঘুরে দেখা গেছে, সিএইচসিপি মিলন বর্মনের নামে বরাদ্দ দেওয়া কোয়ার্টারে ২০১৬ সাল থেকে বসবাস করছেন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার আব্দুস সালাম। অপর সিএইচসিপি মশিয়ার রহমানের বরাদ্দ নেওয়া বাসায় সাত বছর ধরে থাকেন অপর স্যাকমো সৌরভ দত্ত।
স্যানিটারি ইনেস্পক্টর ফরিদ উদ্দিন থাকেন স্বাস্থ্য সহকারী গোলাম রব্বানী মিরুর নামে বরাদ্দের বাসায়। পুলিশ কর্মকর্তা ও কোম্পানির রিপ্রেজেনটিভ রয়েছেন হাসপাতালের কোয়ার্টারে। এ কর্মকর্তারা বরাদ্দ নেওয়া কর্মচারীদের মাধ্যমে সামান্য কিছু টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিলেও এ হাসপাতালের অধিকাংশই ফ্রিতে থাকেন।
সরকারি কোয়ার্টারে এক যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করা ব্রাদার আমির হোসেন রয়েছেন সম্পূর্ণ ফ্রিতে। একইভাবে ফ্রিতে রয়েছেন, ফার্মাসিস্ট মাহাফুজ, ইপিআই টেকনিশিয়ান সান্তনা বেগম, নার্স মৌমিতা, নার্স শ্যামলী রানী, ল্যাব টেকনিশিয়ান সাথী আকতার, নার্স শাহিনা বেগম, নার্স রওশনারা, নার্স নমিতা রানী, নার্স মাধবী রানী ও নার্স রিক্তা বেগমসহ অনেকেই। ডরমেটরিতে ফ্রিতে থাকেন নার্স সুপারভাইজার লক্ষ্মী রানী।
এদিকে কোয়ার্টারের তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনের ফরমে আবেদন করার দুই মাসেও তথ্য দেননি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তবে কোয়ার্টারে বসবাসকারিরা ফ্রিতে ও অন্য নামে বরাদ্দ নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
কোয়ার্টারে ফ্রিতে থাকা ফার্মাসিস্ট মাহাফুজ বাংলানিউজকে বলেন, স্যারকে বলে বিশেষ সুবিধায় কোয়ার্টারে এক বছর ধরে আছি। তবে কোনো ভাড়া কাটে না।
ল্যাব টেকনিশিয়ান সাথী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, গত জানুয়ারি থেকে কোয়ার্টারে আছি। কোনো ভাড়া দিতে হয়নি। মাঝে মধ্যে সংবাদকর্মীদের দিতে হয় বলে কিছু টাকা অফিসের একজনের হাতে জমা দিতে হয়।
নার্স মাধবী রানী বলেন, সরকারি কোয়ার্টারে বিশেষ সুবিধায় থাকি। কোনো ভাড়া কাটা হয় না। তবে সাম্প্রতি নিজ নামে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছি।
কোয়ার্টার বরাদ্দ নেওয়া স্বাস্থ্য সহকারী গোলাম রব্বানী মিরু বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিজ বাড়িতে থেকে অফিস করি। কিন্তু আমার নামে বরাদ্দ নেওয়া কোয়ার্টারে থাকেন স্বাস্থ্য পরিদর্শক ফরিদ। তিনি এ জন্য প্রতি মাসে বেতন থেকে কাটা টাকার পরিমাণ টাকা (পাঁচ হাজার ৯৬৩ টাকা) আমাকে দেন। বাসার যাবতীয় দায়িত্ব তার। আমি বাসা ছেড়ে দিতে সম্প্রতি আবেদনও করেছি।
অন্যের নামে বরাদ্দ নেওয়া স্যাকমো সৌরভ দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, সিএইচসিপির নামে বরাদ্দ নেওয়া কোয়ার্টারে বসবাস করি। তার বেতনের যেটুকু কাটা হয়, তা আমি তাকে প্রতিমাসেই পরিশোধ করি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বসবাসযোগ্য কতোগুলো কোয়ার্টার রয়েছে, তা এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। ফ্রিতে সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করার কোনো নিয়ম নেই। বিশেষ কিছু জানার থাকলে তথ্য অফিসে আবেদন করুন। সেখানে তথ্য পাঠানো হবে।
>>> কাকের বাসায় কোকিলের বাস! রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
বাংলাদেম সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২১
এনটি