ঢাকা: দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় আয়োজিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত এ সম্মেলনে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন তিনি।
সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)।
সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগের জন্য আমরা সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করেছি। যেমন—অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ, পাট-বস্ত্র এবং ব্লু-ইকোনমি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের ১৫টি দেশের ২,৩৩২ জন অংশগ্রহণকারী নিবন্ধন করেছেন জেনে আমি আনন্দিত হয়েছি।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে এসব খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিনদফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগ-নীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, আমরা জাতীয় শিল্পনীতিসহ খাতওয়ারি শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছি। প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য বন্ড ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশন করছি।
অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ২৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ৩৯টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করেছি। পর্যায়ক্রমে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। মীরসরাই, সোনাগাজী ও সীতাকুন্ড উপজেলায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ গড়ে তুলছি।
আড়াইহাজারে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে এবং বর্তমানে ৭৯টি পিপিপি প্রকল্পে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬ প্রণয়ন করেছি এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১৯ সাল থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ৩৫টি সংস্থার ১৫৪টি বিনিয়োগ সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কুটনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে কাজ করছি। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। ৩৬টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত-কর আরোপ পরিহার চুক্তি বলবত আছে। আমরা বিভিন্ন বাণিজ্য জোটের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি। আমরা বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে অবকাঠামোসহ সকল নীতিগত সহায়তা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অগ্রগতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে এখন উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। আমরা ‘এসডিজি প্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। দেশে ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের ১২ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আহরণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের আইটি পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েছি।
বিভিন্ন মেগা প্রকল্প নির্মাণের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করেছি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, সৈয়দপুরে আঞ্চলিক বিমানবন্দর, কক্সবাজারে আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল এবং মাতারবাড়ি ও পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
করোনা মহামারির প্রতিঘাত নিরসনে ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি জানান, অর্থনীতির আকার এখন ৪১১ বিলিয়ন ডলার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ ডলার।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান; সৌদি আরবের ট্র্যান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস বিষয়ক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার সালেহ নাসের এ আল-জাসের; ভারতের কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, কনজুমার অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ফুড অ্যান্ড পাবলিক ডিসট্রিবিউশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মন্ত্রী পীযূষ গয়াল; চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার রেন হংবিন; জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার হোন্ডা টারো; ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফনসো গার্সিয়া মোরা; বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউএএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরেমি উয়ুর্গেন্স; সিংগার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও তুরস্কের কনজুমার ডুরাবল্লের প্রেসিডেন্ট ড. ফতেহ কামাল ইবিকলিওগ্লু; বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২১
এমইউএম/এমজেএফ