কুমিল্লা: কুমিল্লা নগরীর পাথুরিয়া পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ে কাউন্সিলর সোহেলের মালিকানাধীন থ্রি স্টার এন্টারপ্রাইজ। যেখানে খুন হন তিনি ও তার সহযোগী।
সুজানগরের জানু মিয়ার ছেলে শাহআলম (২৮)। শাহআলম কাউন্সিলর সোহেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি। এর আগে, আরো দুটি হত্যা মামলায় তাকে প্রধান আসামি করা হয়। এ নিয়ে মোট তিনটি হত্যা মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়। বুধবার (০১ ডিসেম্বর) রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন শাহআলম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হত্যা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরো ১২টি মামলা রয়েছে। ২০১৪ সালে স্থানীয় দুই পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হন তার বাবা জানু মিয়া। হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যা করেন তিনি। এদিকে ২০১৫ সালে তাকে ধরতে গেলে পুলিশের সঙ্গে শাহআলম ও তার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় দুই চৌকস পুলিশ কর্মকর্তাও গুলিবিদ্ধ হন।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম বাংলানিউজকে বলেন, ওই ঘটনার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেলও খাটেন। আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি। এখন আদালত যদি জামিন দেয়, সেটা তাদের এখতিয়ার।
জানা যায়, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি ও তার পোষাবাহিনী। সুজানগর এলাকায় একটি আস্তানা গাড়েন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে অস্ত্র বানানো, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে আসছিলেন তিনি। পাশাপাশি তার নেতৃত্বে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চাঁদাবাজি ও মাদকের কারবার চলতো। চলতো পতিতাবৃত্তিও।
এদিকে ১৬ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ড লাগোয়া স্থানে শাহআলমের বাড়ি ও আস্তানা হওয়ায় ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়েও অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতেন তারা। এ নিয়ে কাউন্সিলরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব লেগে যায়। সর্বশেষ গত ১৫ নভেম্বর রাতে নারীঘটিত বিষয় নিয়ে কাউন্সিলর ও শাহআলম বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।
জানা যায়, নবগ্রামের এক ছেলের সঙ্গে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাথুরিয়াপাড়ার এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত ১৫ নভেম্বর ওই ছেলে পাথুরিয়াপাড়ায় মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে চোর বলে ধাওয়া করেন স্থানীয়রা। ওই ছেলে শাহআলমের বন্ধু। ধাওয়া করার এক পর্যায়ে তিনি সুজানগরে শাহআলমের বাসায় আশ্রয় নেন। এসময় শাহআলম ধাওয়াকারীদের ভয় দেখিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনাটি মেনে নিতে পারেননি কাউন্সিলর সোহেল। বিষয়টি তিনি পুলিশ-প্রশাসনসহ একাধিক নেতাকর্মীকে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হন শাহ আলম।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই ঘটনার পর থেকে কয়েকদিন গা ঢাকা দেয় শাহআলম বাহিনী। হঠাৎ ২২ তারিখ তারা সশস্ত্র হাজির হন।
র্যাব-১১ সিপিসি-২ সূত্রে জানা যায়, কাউন্সিলর সোহেল হত্যাকাণ্ডের দিন ২২ নভেম্বর হত্যাকারীদের একটি অংশ মুখোশ ও আরেকটি অংশ মুখোশ ছাড়া আসে। গোলাগুলি শুরু হলে স্থানীয়রা ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পাল্টা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের মুখে তাদের প্রতিরোধ অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়। কিলিং মিশনে কাউন্সিলর সোহেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন তারা। এরপর কাউন্সিলর কার্যালয়ের পাশের রাস্তা ধরে চৌরাস্তার দিকে পালিয়ে যান তারা। পুলিশ জানায়, হিট স্কোয়াডে অংশ নেন ছয়জন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চৌরাস্তাটির দক্ষিণ অংশ পাথুরিয়াপাড়া, উত্তর অংশে সুজানগর পূর্ব পাড়া, পশ্চিমে সুজানগর পশ্চিম পাড়া আর পূর্বে নবগ্রাম। পূর্বদিকের রাস্তাটি সোজা চলে গেছে ভারত সীমান্তের দিকে।
কাউন্সিলর সোহেলের ছোট ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ রুমন বাংলানিউজকে জানান, আমার ভাইকে হত্যার দিন তারা ৫০ লাখ টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। এতো টাকার উৎস কী, সেটা খোঁজ নিলেই বেরিয়ে আসবে হত্যাকাণ্ডে ইন্ধনদাতাদের নাম। আমার ভাইয়ের কারণে তারা অপরাধের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারছিল না, তাই তিনি ওদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, খুব অল্পসময়ে আমরা হত্যাকারীদের শনাক্ত ও কয়েকজনকে ধরতে সক্ষম হয়েছি। শিগগিরই পলাতকরা আইনের আওতায় চলে আসবে।
যা বলছেন স্থানীয়রা:-
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের আফিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। শাহআলম বাহিনীর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে পাঁচ সন্তান নিয়ে এলাকা ছাড়া হন তিনি। শাহআলমের মৃত্যুর পর সকালে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বাইরে এলাকায় তার আরও অনুসারী আছে। সবাইকে আইনের আওতায় না আনলে অপরাধ কমানো কঠিন হবে।
১৭ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম (ছদ্মনাম) জানান, ওই বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এতো ব্যাপক আকার ধারণ করে, একটি পানের দোকান দিলেও সেখানে দিনে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হতো তাদের। নতুন ভবন করতে হলে পড়তে হতো আরও বিড়ম্বনায়। চাঁদা দেওয়ার পাশাপাশি ঠিকাদার বাছাই করতে হতো তাদের পছন্দমতো।
মাদকের ভয়াবহ বিস্তার:-
সূত্রমতে, কুমিল্লা নগরীর ২৭টি ওয়ার্ড। তার মধ্যে নগরীর পূর্বাঞ্চলের ওয়ার্ড ১৬ ও ১৭ নম্বর। এই ওয়ার্ড দুইটির পর কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের বিবির বাজার জেলার একমাত্র স্থলবন্দর। এই দুইটি ওয়ার্ড থেকে ভারত সীমান্তের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। সীমান্তবর্তী হওয়ায় এই দুই ওয়ার্ডে মাদকের ছড়াছড়ি রয়েছে। এই দুই ওয়ার্ডে নিম্নবিত্তের মানুষ বেশি থাকায় তাদের দিয়ে মাদকের ব্যবসা করানো হয়। এছাড়া এখানে প্রচুর অস্ত্রও প্রবেশ করছে বলে জানা যায়। এছাড়াও এই দুই ওয়ার্ডের নিকটবর্তী গোমতী নদী। নদীর বালু ও মাটি নিয়েও রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের খেলা। এদিকে আদর্শ সদর উপজেলা ছাড়াও সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করে। বছর পাঁচেক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কুমিল্লার শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা করে। এতে ক্ষমতাসীন দলের দুইজন প্রভাবশালী নেতা ও দুইজন উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম ছিল।
>>> কাউন্সিলর হত্যা: প্রধান আসামিও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
>>> কাউন্সিলর সোহেল হত্যা: দুই আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
>>> কাউন্সিলর সোহেল হত্যা: ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেন অন্তু
>>> কাউন্সিলর সোহেল হত্যায় আরও ২ জন গ্রেফতার
>>> এমপির টাকায় চিকিৎসাধীন সুমন কাউন্সিলর হত্যার আসামি!
>>> কপালে শাহআলম, মাথায় গুলি করেন জেল সোহেল
>>> কাউন্সিলর সোহেল হত্যা মামলার আসামি মাসুম গ্রেফতার
>>> কুসিক কাউন্সিলর সোহেল হত্যা: আসামি সুমন গ্রেফতার
>>> কাউন্সিলর সোহেল হত্যায় মামলা
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২১
এনটি