ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কর্ণফুলী গার্ডেনে দুটি স্বর্ণের দোকানে দুর্ধর্ষ চুরি 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২১
কর্ণফুলী গার্ডেনে দুটি স্বর্ণের দোকানে দুর্ধর্ষ চুরি  কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেটে দুটি স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়েছে | ছবি: ডিএইচ বাদল

ঢাকা: রাজধানীর কাকরাইলে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেটের চার তলায় দুটি স্বর্ণের দোকানে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। পাশের ভবন হয়ে মার্কেটের বাথরুমের এক্সট্রাকশন ফ্যান খুলে প্রবেশ করে দুটি দোকানের প্রায় সব অলঙ্কারই নিয়ে গেছে চোর।

শুক্রবার দিবাগত রাতের কোনো এক সময় দুর্ধর্ষ এই চুরির ঘটনা ঘটে। মার্কেটের বাইরে মেইন গেইটের সামনে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করলেও কেউ টের পাননি ভেতরের ঘটনা। দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সেগুলো রাতের বেলায় বন্ধ ছিল। তবে মার্কেটের সিসিটিভি ক্যামেরায় দুজনকে দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে দুটি স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়েছে, এর একটি মোহনা জুয়েলার্স ছিল মার্কেটের সবচেয়ে জমজমাট দোকান। জুয়েল অ্যাভিনিউ নামে চুরি হওয়া আরেকটি দোকান ছিল সুসজ্জিত। এই দোকানে স্বর্ণালঙ্কার কম থাকলেও ডায়মন্ডের দামি অলঙ্কার ছিল।

চুরি হওয়া দুটি দোকান পাশাপাশি নয় বরং চতুর্থ তলার দুই পাশে। যেভাবে চোর প্রবেশ করে দীর্ঘ সময় ধরে চুরি করেছে, এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এমনকি চুরির আগে বেশ ভালোভাবেই ঘটনাস্থল রেকি করা হয়।



শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানে গিয়ে দেখা যায়, মোহনা জুয়েলার্সের শাটারে লাগানো তালার হুকগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। শাটার খোলার পর কাচের গ্লাস ভেঙে দোকানে প্রবেশ করে চোর। এছাড়া, জুয়েল অ্যাভিনিউতে শাটারের তালা ভাঙা হয়েছে। দোকান দুটির শোকেসে সাজিয়ে রাখা প্রায় সব অলঙ্কারই লুট করে নেওয়া হয়েছে।

মোহনা জুয়েলার্সের পাশেই মার্কেটের বাথরুমের এক্সট্রাকশন ফ্যান খুলে রাখা আছে। বাথরুমের দরজাটি মার্কেটের ভেতরের দিক থেকে তালা দেওয়া থাকলেও ভেতর থেকে নাট খুলে দরজা খুলে ফেলা হয়েছে।

তপন গুপ্ত ও নির্মল গুপ্ত নামে দুই ভাই মোহনা জুয়েলার্সের মালিক, বংশ পররম্পরায় তারা স্বর্ণের ব্যবসা করে আসছেন। তপন গুপ্ত জানান, তার দোকান থেকে অন্তত সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ ভরি স্বর্ণ চুরি হয়েছে। এছাড়া দোকানের ক্যাশ থেকে নগদ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা লুট হয়েছে।

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলছিলেন তপন গুপ্ত। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, অনেক কাস্টমার স্বর্ণালঙ্কার রিপেয়ার করতে, অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে গেছে। গতকাল সকালেও একজন ৫ লাখ টাকা দিয়ে গেছে। আমার তো আর কিছুই রইল না, আমি লোকজনকে এখন কীভাবে স্বর্ণ ফেরত দেব? তাদের কী বলবো?

তিনি বলেন, সকাল বেলা ময়লা ওয়ালা এসে দেখে তালা ভাঙা। তারপর তারা মার্কেট কর্তৃপক্ষকে জানায়, এরপর তারা আমাদের বিষয়টি জানায়। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে!

মোহনা জুয়েলার্সের কর্মচারী মধূসুধন পাল জানান, তিনি ও শাকিল হোসেন নামে দুইজন কর্মচারী দোকানে কাজ করেন। শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করে তারা দুজনেই বাসায় চলে যান। এরপর সকালে দোকান মালিকের ফোনে চুরির খবর জানতে পারেন।

তিনি বলেন, মার্কেটের সেন্ট্রাল বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয় রাতে। সেজন্য দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরাও বন্ধ হয়ে যায়। ক্যামেরার ইলেক্ট্রিক লাইন ম্যানেজ করা বা আইপিএস লাগানোর আলোচনা চলছিল। এর মধ্যেই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।



বংশগতভাবে স্বর্ণের ব্যবসা করা জুয়েল অ্যাভিনিউর মালিক বিপ্লব রায় বলেন, আমি নিজে ২২ বছর ধরে এই দোকান পরিচালনা করছি। এর আগে আমার বাবা-দাদা একই ব্যবসা করেছেন। আমার দোকানে লুট হওয়া অলঙ্কারের ভরির হিসেব করা যাবে না। অনেকদিন ধরেই আমি মালামাল মিলিয়ে দেখি না। দোকানের স্বর্ণ আর ডায়মন্ডের অলঙ্কারগুলো নিয়ে গেছে। অন্তত পৌনে চার লাখ টাকা নগদসহ ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। চোর সব নিয়ে গেলেও রুপার অলঙ্কারগুলো ধরেনি। এ থেকে বোঝা যায় যারা এসেছে, তারা নিশ্চয়ই সব জানে এবং অভিজ্ঞ।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসা বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সহ-সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ২০০৪ সালেও একবার একই মার্কেটের সুলতানা জুয়েলার্স ও মহানগর জুয়েলার্সে চুরির ঘটনা ঘটেছিল। এভাবে প্রায়ই বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকার স্বর্ণের দোকানে চুরি হচ্ছে। দোকান মালিকদের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা মামলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাবো স্বর্ণের দোকানে চুরির ঘটনাগুলো কোনো একটি সংস্থার কাছে তদন্তভার দেওয়ার জন্য। তাহলে হয়তো একটা চুরির সঙ্গে আরেকটার লিংক খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, এই মার্কেটের সবচেয়ে বেশি গয়না ও জাঁকজমক দোকান হচ্ছে মোহনা জুয়েলার্স। এই দোকান এবং আরেক পাশের আরেকটি দোকানে চুরি হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং জড়িতরা আগে থেকেই ভালোভাবে রেকি করেছে।

কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির দোকান মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন টিটু বলেন, ২০০৪ সালে চুরির পরে জানা যায়, জড়িতরা ঘটনার কয়েক মাস আগে মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আগে সিকিউরিটির লোকজন রাতে মার্কেটের ভেতরে থাকত। এরপর থেকে সিদ্ধান্ত হয় রাতে মার্কেটের ভেতরে কেউ থাকবে না, সব দোকান বন্ধ করার পর দুজন সব দোকান চেক করে আসেন এবং সবশেষে সুপারভাইজার চেক করে মেইন গেইট বন্ধ করে দেন। রাতে মার্কেটের বাইরে সিকিউরিটি গার্ডরা থাকলেও ভেতরে কেউ থাকে না।

বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কারণে দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কয়েকবছর আগে একবার মার্কেটে আগুন লাগে। সেজন্য সেন্ট্রালি রাতে মার্কেটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে মার্কেটের নিজস্ব সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সচল থাকে আইপিএসের মাধ্যমে। সেসব ক্যামেরায় পুরো মার্কেটই দেখা যায়। পুলিশ মার্কেটের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কেটের এক নিরাপত্তারক্ষী বলেন, আমরা রাতে মার্কেটের বাইরে দায়িত্বে থাকি। চার তলায় কী হয়েছে, তা আমাদের জানার কথা না। তাছাড়া কোনো শব্দও পাইনি আমরা।

মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. মোখলেছুর রহমান, বর্তমানে মার্কেটের নিরাপত্তায় একজন সুপারভাইজার আছেন। আর আমাদের সকল সিকিউরিটি গার্ডই নিজেদের নিয়োগ দেওয়া। তারা সার্বক্ষণিক এখানে থাকেন ও দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বলেন, মার্কেটের একেবারে পেছনের দেয়াল ঘেঁষে গাউসিয়া ভবন নামে একটি নির্মাণাধীন দেয়াল রয়েছে। সেটির দেয়াল ঘেঁষে তৈরির কীভাবে অনুমোদন পেলো আমাদের জানা নেই। আমরা বেশ কয়েকবার তাদের ভবন নির্মাণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সেই নির্মানাধীন ভবন হয়েই মার্কেটে চোর প্রবেশ করেছে। সেই ভবনের সিসিটিভি ফুটেজেও বিষয়টি ধরা পড়েছে। ভবনটি নিয়ম মেনে নির্ধারিত দূরত্বে তৈরি হলে আজকে এমন ঝুঁকি থাকত না।

তিনি আরও বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে দুই চোরকে দেখা গেছে, তারা বাথরুম হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং সেখান দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে, তারা বিস্তারিত বলতে পারবে।

এদিকে, দুর্ধর্ষ এই চুরির পর থানা পুলিশসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে ডিবি, সিআইডি ও পিবিআইর টিম। তারা বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।

রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম জানান, ধারণা করা হচ্ছে, চোর দুই জন ছিল। ঘটনার অনুসন্ধানে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে, বিস্তারিত তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২১
পিএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।