ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

খুললো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, বাড়বে রেমিট্যান্স

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
খুললো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, বাড়বে রেমিট্যান্স

ঢাকা: দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর ফের বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারের দুয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে খুলেছে। নতুন করে দেশটি বৃক্ষরোপণ, বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন, নির্মাণ এবং গৃহকর্মী নেবে।

দুদেশের মধ্যে কর্মীসংক্রান্ত এমওইউ সই এর পর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে আর কোনো বাধা থাকলো না। এতে জনশক্তি রপ্তানির বাড়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়বে। সঙ্গে অর্থনীতির চাকা আরও বেগবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোববার (১৯ ডিসেম্বর) মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দেশটির সঙ্গে কর্মী পাঠানো সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ ও মালয়েশিয়ার পক্ষে দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান এই সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরই বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কার্যকর হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দিতে মালয়েশিয়ার সরকার দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের অনুমতি দেয়। এদিনই ১০ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারকে সই করার জন্য দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদকে আমন্ত্রণ জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতিক্রমে গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী।

এ বিষয়ে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান বলেন, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া শুরু হবে। এই শ্রমিকদের জন্য বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন, নির্মাণ এবং গৃহপরিচারকসহ বিভিন্ন খাত উন্মুক্ত থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মানুসারে মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুকদের সে দেশে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হতে পারে।

এবিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি ( বায়রা) সাবেক সভাপতি বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, মালয়েশিয়া আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। তিন বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর আবার খুলছে৷ এজন্য উভয় দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এ শ্রমবাজার খোলায় জনশক্তি রপ্তানি খাতে নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বেকারত্ব সংখ্যা কিছু কমবে। আর বাড়বে রেমিট্যান্স। করোনার কারণে গত দুই বছরে ধীর গতির অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া সরকার যে প্রস্তাব দেবে আমরা সেটাই মেনে নেব। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো প্রস্তাব পাইনি। আশা করছি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আগের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, দীর্ঘ তিন বছর পর মালয়েশিয়া আবারও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া শুরু করবে। মন্ত্রীর নেতৃত্বে ও আমাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শ্রমবাজারটি পুনরায় উন্মুক্ত হয়েছে। সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন খাতে বহু বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

সচিব বলেন, করোনা সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার সঙ্গে সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই আড়াই লক্ষাধিক কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে গত নভেম্বর মাসে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। বিদেশ গমনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ অর্থবছরে সাত থেকে আট  লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এছাড়া গ্রিসের সঙ্গে একটি আগ্রহপত্র স্বাক্ষর করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী। একইভাবে আলবেনিয়া, মাল্টা ও বসনিয়ার সঙ্গেও কর্মী পাঠানোর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, সেনেগাল, বুরুন্ডি, সেশেলস, মালয়েশিয়ার সারওয়াকে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, নানা অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। এরপর দীর্ঘ ৭ বছর বন্ধ থাকার পর মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।

পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে। কিন্তু প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ওই ১০ এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই বছরে ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বাংলাদেশি কর্মীদের আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে আগে যারা ভিসা পেয়েছিলেন, তারা পরেও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পান।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন মজুরি এক হাজার ২০০ রিঙ্গিত। যা বাংলাদেশি ২৪ হাজার ৪২০ টাকার সমপরিমাণ। ফলে বলা যায় বাংলাদেশি কর্মীদের বেতন এক হাজার ২০০ রিঙ্গিতের কম হবে না। কিন্তু ওই সময় দুই দেশের সমঝোতা অনুযায়ী সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে খরচ হওয়ার কথা ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা। তবে ওই ১০ সিন্ডিকেট প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে চার লাখ টাকা করে নেয়। এতে করে কমবেশি দুই লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠাতে ওই সিন্ডিকেট আনুমানিক সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে দেশটিতে ৭০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী যান। বহুল আলোচিত জিটুজি প্লাস চুক্তি সইয়ের পর, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে প্রায় পৌনে এক লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয় দেশটিতে। মালয়েশিয়া সরকারের পছন্দ করা বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি এই কর্মীদের পাঠায়।

আগে মালয়েশিয়ায় এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ করা হতো। এর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাঠাত বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। আগামীতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আনবে। সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। কর্মীরা যেনো প্রতারিত বা নির্যাতিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকার নরজদারি করবে।

সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারারস (এফএমএম) জানায়, শিল্পখাতে আগামী বছর নাগাদ তাদের ছয় লাখের বেশি শ্রমিক লাগবে। রপ্তানিভিত্তিক কোম্পানিগুলোতে এই শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

উল্লেখ্য, দেশে লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৮০০টি। এর মধ্যে এক হাজার ৩০০ জনশক্তি ব্যবসায় রয়েছে। বাকিদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও কর্মী নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনা হয়েছিল। তখন মালয়েশিয়ার প্রস্তাব ছিল সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি এজেন্সি কর্মী পাঠাবে। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল কমপক্ষে আড়াই থেকে তিনশ' এজেন্সিকে যুক্ত করার।

>>>আরও পড়ুন: মালয়েশিয়া যেতে যেসব সুবিধা পাচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯,২০২১
জিসিজি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।