ঢাকা: রাজধানীর মিরপুর থেকে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের মূলহোতাসহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৪)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভুয়া পাসপোর্ট, নকল ভিসা ও দলিল জব্দ করা হয়।
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর পল্লবী ও উত্তরায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- চক্রের মূলহোতা মল্লিক রেজাউল হক ওরফে সেলিম (৬২) এবং তার দুই সহযোগী মো. বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫) ও নিরঞ্জন পাল (৫১)।
গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মানুষ জনকে টার্গেট করে তাদের অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখাতো। এই প্রলোভনে যারা রাজি হতো তাদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নিতো। পরে চক্রটি প্রবাসে যেতে ইচ্ছুকদের বলতো, বাংলাদেশ থেকে ভিসা পাওয়া জটিল তাই তাদের ভারতে নিয়ে গিয়ে খুব সহজে কাঙ্ক্ষিত দেশে পাঠানো হবে। কারণ ভারত থেকে ভিসা পাওয়া সহজ বলে ভিকটিমদের জানায় চক্রটির সদস্যরা।
ভারতের নিয়ে গিয়ে ভিকটিমদের প্রথমে সেইফ হাউজে রাখা হতো। তারপর তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন। এসব নির্যাতনের চিত্রের ভিডিও ধারণ বাংলাদেশ থাকা ভিকটিমদের পরিবারকে দেখাতো চক্রটি।
পরিবারকে তারা এসব ভিডিও দেখিয়ে বলতো, ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে ভিকটিমকে মেরে ফেলবে। পরে ভিকটিমদের পরিবারগুলো প্রিয়জনকে বাঁচাতে সর্বস্ব বিক্রি করে চক্রটির সদস্যদের হাতে টাকা তোলে দিত।
মঙ্গলবার (২১) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা বলে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তিকে ভারতে পচার করে দেয় চক্রটি। পাচার হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভারেতর কলকাতায় আটক থাকে জাহাঙ্গীর। আটক অবস্থায় কলকাতার টর্চার সেলে তাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে নির্যাতনের এসব ভিডিও দেখিয়ে দেশে থাকা তার পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায় করে পাচারকারী চক্রটি। দেশে এসে ভিকটিম জাহাঙ্গীর চক্রটির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে আমাদের কাছে। তার দেওয়া তথ্য ও অভিযোগ যাচাই করে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
চক্রের মূলহোতা মল্লিক রেজাউল হক সেলিম ও তার সহযোগী বুলবুল আহমেদ মল্লিক এবং নিরঞ্জন পালসহ এই চক্রে তাদের সহযোগী হিসেবে দেশে আরও ৫ থেকে ৭ জন সদস্য রয়েছে। তাছাড়া ভারতেও তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কলকাতার রাজিব খান, মানিক ও দিল্লির রবিন সিংদের নাম পাওয়া যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচারের করে আসছে।
চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের টার্গেট করে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স এবং মাল্টায় উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখায়। তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে কৌশলে ভারতে পাচার করে দিত।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে ভারত থেকে ভিসা পাওয়া সহজ এই কথা বুঝিয়ে তাদেরকে প্রতারিত করে এই চক্রটি ভিকটিমদেরকে ভারতে বৈধ এবং অবৈধ পথে পাচার করে দেয়। প্রথমে ভিকটিমদের কলকাতা থেকে নেওয়া হতো দিল্লির একটি টর্চার সেলে।
কলকাতার টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকতো ভারতীয় নাগরিক রাজিব খান ও মানিক ও দিল্লির টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকতো রবিন সিং। পরে ওইসব টর্চার সেলে ভিকটিমদের উপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্র ভিডিও ধারণ করে প্রত্যেকটি টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ চক্রটির মূলহোতার কাছে পাঠাতো। পরে মূলহোতা মল্লিক তার সহযোগীদের মাধ্যমে ভিডিও ভিকটিমদের পরিবারের কাছে পাঠাত।
ভিকটিমদের পরিবারগুলো যে পর্যন্ত তাদের মুক্তির জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিত সেই পর্যন্ত তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চলতেই থাকতো। এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।
চক্রের অন্যান্য হোতাদের গ্রেফতারে র্যাব-৪ এর অভিযান চলমান রয়েছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে রুপনগর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২১
পিএম/এনএইচআর