ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

’৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২২
’৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে ’৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।

শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের দশম জাতীয় সম্মেলনে তারা এই দাবি জানান।

সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন। এ সময় ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, মানবতা-মানবাধিকার ও সাম্য-সমঅধিকারের আজ বড় দুর্দিন। জোর করে এই রাষ্ট্রের মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে। পাহাড়ে-সমতলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। বলা হয় তিন ভাগের দুই ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। দেশত্যাগের আগে যখন দেহত্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে তখন মানুষ দেশত্যাগ করে।

তিনি বলেন, আমরা মানবাধিকার চাই, সমঅধিকার চাই। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তার দেহ পড়ে থাকে―তখন আমার প্রশ্ন জেগেছিল রাষ্ট্র তুমি কার? যখন শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়, তখনও একই প্রশ্ন জেগেছে। আজ জোরালোভাবে প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্র তুমি কার? একসময় বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু এবার ৭২টি মন্দির ভাঙা হলো। ১৮টি জেলায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ হলো। অথচ পূজার আগে বলা হয়েছে জঙ্গি হামলা হবে না।

তিনি আরও বলেন, আক্রমণের দুই ঘণ্টা পর পুলিশ আসে। গোয়েন্দারা আগে থেকে তথ্য দিতে পারে না। ২০০১, ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২১ সালে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে তাতে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র কেন নির্বিকার? এই জায়গায় রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে। কোথায় যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ? বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সংখ্যালঘু বা আদিবাসী মানুষ বিপন্ন হবে, তাদের কান্না শুনতে হবে―এই জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি।

প্রবীণ আইনজীবী এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, সাম্প্রদায়িকতার ছোবলের প্রভাব সরকার, প্রশাসন, সংবিধান সর্বত্র পড়ছে। যে অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, আজ তার পরিবর্তে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় খাতের বাজেটে মোট বরাদ্দের ১.৮ ভাগ সংখ্যালঘুদের জন্য। পাঠ্যপুস্তকে সব ধর্মের সমমর্যাদার প্রতিফলন ঘটেনি। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়ন হয়নি। সংখ্যালঘুদের ভূমির ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ’৭২- এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পুনঃপ্রবর্তন ঘটবে না।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে তখন সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। এরশাদ ভোটারবিহীন সংসদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন। তখন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের জন্ম হয়। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে বহু প্রচেষ্টায় মূল চার নীতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ৫ম সংশোধনী ও ৮ম সংশোধনী বাদ দিতে পারিনি। এজন্য আমরা ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এটা করলে সম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটবে। চোখের সামনে আজ সেটা দেখছি। সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাদের সহযোগীরা বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হেফাজত হামলা করলো হিন্দু ধর্মালম্বীদের ওপর। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে হুমকি দেওয়া হলো, এখন সেখানে আর ভাস্কর্য হচ্ছে না। এগুলো সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছিলেন ধর্মের ভিত্তিতে আমরা বিভক্ত হবো না, বিভক্ত থাকবো না।

ছবি: জি এম মুজিবুর

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আজ আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আগামীকাল আমরা কোথায় যাবো―এই প্রশ্ন আসছে। অস্থিত্বহীনতার প্রশ্ন তখনই আসে যখন গণতন্ত্রহীনতা বিরাজ করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধর্ম নিরপেক্ষ হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষ না হলে সেই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হতে পারে না। যে কোনো মানুষের রাষ্ট্রের কাছে পরিচয় নাগরিক, ধর্ম পরিচয় নয়। সংবিধানে একদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতা আবার একটি ধর্ম বলবৎ। অসাম্প্রদায়িক হতে হলে দুইটা দিয়ে হবে না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আমাদের যেটা দরকার ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব সেটা হয়নি। তাই সেই পুরোনো বাস্তবতা আজ জেঁকে বসেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হতে হবে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমরা কিছুই করতে পারবো না।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, এ ধরনের সংগঠনের জন্ম লাভ, ৩৩ বছর টিকে থাকা―এটা আমাদের জন্য পরিতাপের বিষয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামতে হবে কেন? বঙ্গবন্ধু ’৭২-এ যে সংবিধান দিয়েছিলেন সেখানে বলা হয় সমান অধিকার, স্বাধীনতা। মূল নীতি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম পরিচয়ে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে মৌলিক ভিত্তির ওপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাকেও হত্যা করা হয়েছে। সংবিধানের ৫ম সংশোধনী আনেন জিয়াউর রহমান, ৮ম সংশোধনী আনেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আজ সেই উত্তরাধিকার বহন করতে হচ্ছে।

ছবি: জি এম মুজিবুর

তিনি আরও বলেন, বিএনপির আমলে ২৬ জন এমপি, মন্ত্রীর ইন্ধনে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছিল। আজ দুর্গোৎসবে হামলা হয়েছে―তার প্রতিকার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে যে লড়াই-সংগ্রাম করছেন তার সঙ্গে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। শেখ হাসিনা থাকলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের সহযোগীদের শেকড় উপড়ে দিতে না পারলে সমস্যা দূর হবে না।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক ও উষাতন তালুকদার। এতে আরও বক্তব্য দেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রীয় ভট্টাচার্য্য, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি, সংসদ সদস্য এ্যারোমা দত্ত, মনোরঞ্জনশীল গোপাল প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময় ২০৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২২
এসকে/এনএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।