ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

এবার ওসির সঙ্গে এমপি শম্ভুর ফোনালাপ ফাঁস

জাহিদুল ইসলাম মেহেদী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২২
এবার ওসির সঙ্গে এমপি শম্ভুর ফোনালাপ ফাঁস

বরগুনা: এবার বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ও সদর থানার ওসির ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। যা এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

তবে কীভাবে এই ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত বুধবার (৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যা থেকে ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের কথোপকথনের রেকর্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এরপর জেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সেই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ফোনালাপের রেকর্ড।

ধারণা করা যায় ওই ফোনালাপ গত ২ জানুয়ারির। এতে শোনা যায় শম্ভু তার আত্মীয়র বিরুদ্ধে থাকা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সদর থানার ওসিকে মুঠোফোনে চাপ দিয়েছেন। মুঠোফোনে সংসদ সদস্য ও ওসির কথোপকথনের রেকর্ডে বিষয়টি উঠে এসেছে। ওসি তারিকুল ইসলাম ফোনালাপের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সাংসদ ও ওসি তারিকুলের কথোপকপন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

সাংসদ: ওসি সাহেব।

ওসি: জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম।

সাংসদ:: আপনার পরবর্তীতে দারোগা কি (ওসি পদটি দারোগা নয়, পরিদর্শক) বরগুনায় আসছে?

ওসি: পরবর্তী?

সাংসদ: আপনি জানেন না, আপনি যখন চলে যাবেন, তখন যে আসবে সে কি আসছে বরগুনায়?

ওসি: স্যার...

সাংসদ: প্রশ্নটা অনেক কড়া, না?

ওসি: অনেক কঠিন, কড়া স্যার। স্যার, আমি তো আপনাদের রেখে যেতে চাই না।

সাংসদ: ঠিক আছে। আচ্ছা আপনি কোথাও বলেছেন সাবু (সাহাবুদ্দিন সাবু, জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী) যুবলীগে আপনার প্রার্থী?

ওসি: না স্যার।

সাংসদ: এই কথা আপনি কারও সাথে বলছেন?

ওসি: আমার প্রার্থী হয় কীভাবে, আমি কি রাজনীতি করি?

সাংসদ: আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না বলছেন। বলছেন কি না, চিন্তা করেন।

ওসি: না স্যার।

সাংসদ: মেশেন তো সবার সাথে, কোন গুণ্ডার ধারে বসে কী কইছেন কে জানে।

ওসি: স্যার এটা ফালতু কথা, ফালতু কথা আমি বলতে পারি না।

সাংসদ: এটা আপনি পারেন না, এসপি সাহেব কইতে পারে?

ওসি: না স্যার সে–ও বলতে পারে না, আপনারা বলতে পারেন।

সাংসদ: বোঝেন না এলাকায় কত কথাই না হয়।

ওসি: এটা কোনো কথা স্যার? আমরা বলব কেন, এক সময় আমরা ছাত্রলীগ করেছি ঠিক আছে। এখন তো বলার কোনো স্কোপ (সুযোগ) নাই। আজ তো স্যার বিএনপিকেও প্রোগ্রাম করতে দিলাম।

সাংসদ: তারপর, করবে না কেন? ভদ্র আচরণ করলেই হয়, অভদ্র আচরণ করলেই পিটান। অভদ্র, মারমুখী হইলে তখন আমরা পুলিশকেও জিজ্ঞেস করব না, তখন আমাদের পোলাপান পিটাইবে। বইলা দিয়েন আপনারা (বিএনপি) করলে ভদ্রভাবে কইরেন।

ওসি: জি স্যার, তারা ভদ্রভাবেই করছে।

সাংসদ: ৬ নম্বরে (বুড়িরচর ইউনিয়ন) ইউনিয়ন ইলেকশনের সময় যে মামলাগুলা হইছিল, সেগুলা কী অবস্থায় আছে?

ওসি: স্যার ওগুলা কি পেন্ডিং আছে।

সাংসদ: হ্যাঁ পেন্ডিং আছে না। রিপোর্ট তো দেন নাই এখনও। যাওয়ার আগে ওগুলা গুছাইয়্যা দিয়া যাইয়েন।

ওসি: দিমু স্যার।

সাংসদ: আবার তাইলে আমরা বরগুনায় অ্যাডিশনাল বা এএসপি কইরা নিয়া আসমু।

ওসি: না স্যার দোয়া কইরেন। আমার আর প্রমোশনের দরকার নেই, এই র‌্যাঙ্কেই যেন বাড়ি যাইতে পারি।

সাংসদ: অনেকে এএসপি হইতে চায় না, ওসিই থাকতে চায়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২১ জুন বুড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সংসদ সদস্যের আত্মীয় সিদ্দিকুর রহমান। নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হুমায়ুন কবিরের কাছে হেরে যান। ওই নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ভোটগ্রহণের আগ পর্যন্ত দুই পক্ষে একাধিক সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় দুই পক্ষ থানায় কমপক্ষে ১০টি মামলা করে। মামলায় উভয় পক্ষের অন্তত ১২২ জনকে আসামি করা হয়।

সদর উপজেলার‌ ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর বলেন, নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমানের ভগ্নিপতি ইউনুস মৃধার ঘরে আগুন দেওয়ার মামলাটিরও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ। এ ঘটনার পর ওসির ওপর ক্ষুব্ধ হন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তার ইচ্ছেমতো প্রতিবেদন না দেওয়ায় ওসির ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বলে আমি জানতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমানের অনুসারীদের হামলার ঘটনায় আমার নেতাকর্মীরা চারটি মামলা করেছিল। সেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পুলিশ যাতে আদালতে দাখিল করে, সিদ্দিকুর রহমান সেই চেষ্টা করছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় সংসদ সদস্য শম্ভুকে দিয়ে ওসিকে বদলির হুমকি দিয়েছেন মো. সিদ্দিকুর রহমান।

অপরদিকে মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘হুমায়ুন কবির তার ক্যাডার বাহিনী ব্যবহার করে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনে জিতেছেন। আমার নেতাকর্মীদের মারধর করেছেন। তাই আমার আত্মীয় ও দলীয় নেতাকর্মীরা ছয়টি মামলা করেছিল। পুলিশ দুটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। তার একটিতে আপত্তি দিয়েছি। সেটি ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। আমি কোনো মামলায়, কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করিনি।

তিনি আরও বলেন, পুলিশকে প্রভাবিত করার প্রশ্নই আসে না। কারণ ওদের দায়ের করা মামলাগুলো ভিত্তিহীন। আমি সব সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম তারিকুল ইসলাম মুঠোফোনে বাংলানিউজকে বলেন, বেশকিছু ইউনিয়নের নির্বাচনী সহিংসতার মামলাগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে এমপি সাহেব মুঠোফোনে যে আচরণ করেছেন, তাতে আমি মর্মাহত।

এ বিষয়ে জানতে বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সেজন্য ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি। আমি তার কাছে কোনো অন্যায় আবদার করিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘ওসির সঙ্গে  মুঠোফোনে আমার কথোপকথনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোও এক ধরনের অপরাধ বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২২
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।