ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দু’মুঠো ভাতের জন্য বরফশীতল পানিতে হাজারো শ্রমিক

সোহাগ হায়দার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২২
দু’মুঠো ভাতের জন্য বরফশীতল পানিতে হাজারো শ্রমিক

পঞ্চগড়: পাহাড়ি হিমেল হাওয়ার কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। তাপমাত্রার পারদ কখনো ৮ দশমিক ৭, কখনো বা ১০ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে।

উত্তরের হিমালয় থেকে বয়ে আসছে বরফ গলা পানি। এমন ভোরে দু’মুঠো ভাতের জন্য ঘাড়ে ফোলানো টিউব, ঢাকি, কোদাল আর চালনি নিয়ে ছুটছেন শ্রমিকরা।  হিমালয় থেকে বয়ে আসা বরফগলা মহানন্দার ঠাণ্ডা জলরাশিই এখন তাদের জীবিকার উৎস।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরফশীতল পানির নদীর বুক থেকে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করেন ওই শ্রমিকরা।  এরপর সেই পাথর বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালান। দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কয়েক হাজার দরিদ্র পরিবারের জীবন-জীবিকা চলে এভাবেই।

মূলত এ উপজেলার একেবারে কাছে অবস্থিত হিমালয় পর্বত। এ জেলায় শীত বেশি পড়ে।  সারা বছর এ নদী থেকে পাথর তোলা হয়। কনকনে শীতেও অনেকে পাথর তোলেন।

একটি দলে আট-নয়জন করে পুরুষ শ্রমিক থাকেন। দিন হাজিরা হিসেবে তিনশ’ থেকে প্রায় চারশ’ টাকা করে প্রতি জনে পান। তবে পাথর বেশি তুলতে পারলে একেকজন শ্রমিক দিনে সাতশ’ থেকে আটশ’ করে টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।  

তিনদিন পর পর এক দল মিলে পাথর তুললে এক ট্রলি পাথর পাওয়া যায়। প্রতি ট্রলি পাথর বিক্রি হয় নয় হাজার টাকায়।  

তেঁতুলিয়ায় মহানন্দার পাড় ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার অংশে হিমালয় পর্বত থেকে বরফগলা পানি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশকে ভাগ করে মহানন্দায় প্রবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে নদীপাড়ের কয়েকটি গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার মানুষের জীবন জীবিকা নদী কেন্দ্রিক। শুধু নদীর পাড়ের বাসিন্দারাই নন, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নদীর গভীর অংশ থেকে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে পাড়ে স্তূপ করেন। সেই স্তূপ করা পাথর নারী ও শিশুরা আকার অনুযায়ী বাছাই করেন। সবশেষে সন্ধ্যায় মহাজনের কাছ থেকে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তারা। এতে করে একজন পুরুষ শ্রমিক দিনে আয় করেন সর্বোচ্চ সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা। নারীরা পান হাজিরা হিসেবে সর্বোচ্চ তিনশ’ টাকা। সারা বছরই চলে এ পাথর উত্তোলনের কাজ। প্রচণ্ড শীতেও অভাব ও ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে তাদের নামতে হয় বরফ গলা পানিতে। শীতের সময় এ উপজেলায় প্রায়ই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে। শীতে তুলনামূলক কম পাথর তোলা হয়। এমন শীতে শ্রমজীবী মানুষের তেমন কাজ থাকে না। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা পড়েন বিপাকে। মোট নারী শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকই শীতে কর্মহীন হয়ে পড়েন। এ অঞ্চলের শতকরা ৩০ শতাংশ নারীই স্বামী পরিত্যক্তা। একাধিক সন্তানসহ পরিবারের খাদ্যের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হয় তাদের।  

তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা দিনমজুর উসমান আলী বাংলানিউজকে বলেন, সংসার চালাতে সারা বছর মহানন্দা নদীর বুকে ছুটে যেতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেসব পাথর সংগ্রহ করি, সেসব সন্ধ্যায় বিক্রি করে সেই টাকায় সংসার চালাই।  

একই কথা জানান আরেক শ্রমিক জব্বার আলী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মূলত এ অঞ্চলে তেমন কোনো আয় রোজগারের ব্যবস্থা না থাকায় এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য হওয়ায় কাজ না পেয়ে নদীতে নামতে হচ্ছে। তবে শীত মৌসুমে বরফগলা পানিতে পাথর তুলতে অনেক কষ্ট হয়। আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই শীতবস্ত্র পেলেও আমরা এখনো পাইনি।

ময়না বেগম নামে এক শ্রমিক বাংলানিউজকে বলেন, সারাদিন কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক যে টাকা পান, তার থেকে অনেক কম পাই আমরা। যাই হোক, সেই টাকা দিয়েই সংসার চলে আমার। কিন্তু শীতে কর্মহীন হয়ে পড়তে হয় আমাদের। তখন ঘরে খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হয়।  

এদিকে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাবান্ধা থেকে ভজনপুর পর্যন্ত এ উপজেলায় প্রায় কয়েক হাজার মানুষের জীবন জীবিকা পাথর কেন্দ্রিক। অনেকেই ভূগর্ভস্থ পাথর তুলতেন আগে। কিন্তু এখন ভূগর্ভস্থ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব মানুষের একটা বড় অংশই বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ বর্তমানে কাজ করছেন সমতলের চা বাগানগুলোতে, বন্দরে। তবে বেশিরভাগই নদী থেকে পাথর তুলে সংসার চালাচ্ছেন।  

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বাংলানিউজকে বলেন, সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় তেমন কোনো শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। সরকারিভাবে এ উপজেলায় বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নানাভাবে সরকারি অনুদানের আওতায় আনা হচ্ছে তাদের। বন্দর ব্যবস্থাপনা জোরদার করে অনেক মানুষকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এসব মানুষের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এরই মধ্যে সরকারিভাবে বেশ কয়েক হাজার শীতবস্ত্র শীতার্ত জনগণের মধ্যে বিতরণ করেছি। সরকারিভাবে আরও শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।