রংপুর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) থেকে সদ্য স্নাতক পাস করে দুই অচল কিডনি নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান। টাকার অভাবে ঠিকমতো প্রাথমিক চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত ছেলেকে বাঁচাতে নিজের একটি কিডনি দিয়েছেন মা বুলি বেগম। ঢাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন শেষে বর্তমানে মা ও ছেলে নিজ বাড়ি পঞ্চগড়ে রয়েছেন।
জাহিদ হাসান বেরোবির বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। তার বাবা ১৭ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
জাহিদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে প্রথমে ১৮ বছর বয়সে এক বোনের ব্লাড ক্যানসারে মৃত্যু হয়। আবার একই বছরের নভেম্বর মাসে ঘুমের মধ্যে জাহিদের বাবার হঠাৎ মৃত্যু হয়। সেদিন থেকেই নিজের স্বপ্ন যেন মরে গিয়েছিল জাহিদের জীবনে। সেই ছোট্টবেলা থেকেই জীবন নামের এক মহাযুদ্ধ অতিক্রম করার পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর জাহিদ জানতে পারেন, তার দুটি কিডনিই কাজ করছে না।
এর আগে ২০১৯ সালেও একবার জাহিদ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সে সময় রংপুরে যে চিকিৎসককে দেখিয়েছিলেন, তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেননি বা অন্য কোথাও রেফার করেননি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে যখন জাহিদ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন একেবারে শেষ ধাপ, আর করার তেমন কিছু ছিল না। ১৭ অক্টোবরের পর ১৫ দিন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন জাহিদ। রংপুরের একটি স্থানীয় ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গেলে তাও বিফল হয়। এর আগে ক্যাথেটারের মাধ্যমে চারটি ডায়ালাইসিস করা হয়েছিল। জাহিদের জ্বর ছিল। খাবার খেলেই বমি করে দিতেন।
এই অসুস্থতার মধ্যেই গত বছরের নভেম্বরে জাহিদের স্নাতকের (সম্মান) ফল প্রকাশ হয়। জাহিদ কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। এরপর তার পরিবার নতুন করে যখন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, ঠিক তখনই জাহিদের অসুস্থতা ধরা পড়ে। সহপাঠীরা যখন স্নাতকোত্তরের জন্য শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছেন তখন জাহিদ জানতে পারেন তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। কিন্তু কিডনি কে দেবে? তা নিয়ে পড়তে হয় মহা দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থায় জাহিদের মা আর বোন কিডনি দেওয়ার জন্য শরীরের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। শেষ পর্যন্ত ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধরা নারী ছেঁড়া ধনকে নিজের কিডনি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জাহিদের মা।
রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার পর গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (সিকেডি) ভর্তি হন জাহিদ। কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি বিষয় সুরাহার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব প্রক্রিয়া শেষে গত ২২ জানুয়ারি রাতে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের সাত দিনের মাথায় বুলি বেগম হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। তবে জাহিদ হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ দিনের মাথায়।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বুলি বেগম বলেন, ‘কিডনি দিতে এত কষ্ট হবে তা জানা ছিল না। তবে এই কষ্টের কথা আগে জানলেও আমি আমার ছেলেকে কিডনি দিতাম। মায়ের কাছে সন্তানের জীবনই আগে। সন্তানের জীবন বাঁচানো মায়ের জন্য ফরজ।
জাহিদের বড় বোন নূর নাহার বলেন, হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর জাহিদের সঙ্গে যখন মায়ের প্রথম দেখা হয় তখন মনে হলো মা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন। জাহিদও হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বারবার জানতে চাচ্ছিল মা ভালো আছেন কি না। আমার ভাই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর তাদের যে আনন্দ হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভাইকে বাঁচানো যাবে না। এখন আমি আমার ভাইকে স্পর্শ করতে পারছি। ভাই চোখের সামনে, সুস্থ জীবনের পথে হাঁটছে—তার যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
সিকেডি হাসপাতালের প্যাকেজে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার, ১১ দিন হাসপাতালে থাকা বাবদ খরচ হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। তবে বিভিন্ন পরীক্ষা ও ওষুধ বাবদ এ পর্যন্ত হাসপাতালে খরচ হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা।
নূর নাহার বলেন, এসব টাকা জোগাড়ের জন্য তার ১০ শতাংশ জমি এবং পৈতৃক ভিটা কম মূল্যে এক আত্মীয়ের কাছে বিক্রি করতে হয়েছে। ওই আত্মীয় নিজেই অসুস্থ থাকায় জমি বিক্রির সব টাকা হাতে পাওয়া যায়নি।
এদিকে জাহিদের অসুস্থতা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর দেশ ও দেশের বাইরের অনেকেই তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।
জাহিদ ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নূর নাহার।
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এখন প্রতি মাসে জাহিদের শুধু ওষুধের পেছনে খরচ হবে ৩০ হাজার টাকা। জাহিদ ও তার মায়ের ফলোআপ, খাওয়াদাওয়াসহ বেশ মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
এমএমজেড