ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২২
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

খুলনা: ‘তিন মাস ধইরে মাছ খাই না। কিনমু ক্যামনে? দাম বেশি।

আয় রোজগার কুমলেও সব জিনিসের দাম বাড়ছে। যে কারণে পোলাপানরে ভালো খাওয়াতি পারি না। ’

দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন আলামিন নামে খুলনা মহানগরীর এক রিকশাচালক। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি পিষ্ট হচ্ছেন মেস বা হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরাও।  

সরকারি বিএল কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন বলেন, কলেজের হলে আবাসন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বাইরে বিভিন্ন মেসে থাকি। কিন্তু করোনার প্রভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের টিউশনিও চলে গেছে। এর ওপর দ্রবমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছি। আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতিমাসে আরও এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি লাগছে। যা পরিবার থেকে দেওয়া অনেকের জন্যই বেশ কষ্টকর।

অয়েজুল হক নামে এক চাকরিজীবি বলেন, তেল গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। সাধারণ মানুষ অসাধারণ হতে পারছে না বলে তাদের কষ্টের সীমা নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরায় - প্রবাদটি আজ চরম সত্য হয়ে ঘাড়ে বসেছে।

নগরীর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা বনানী আফরোজ বলেন, খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের বিরূপ প্রভাব পড়েছে অতিদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। আলু ছাড়া সব পণ্যের দাম বেশি। যে কারণে নিম্ন আয়ের লোকজন আলু খাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে অসহায় মানুষের দুঃখের কথা বলার কোনো জায়গাও নেই।

বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। চাল, ডাল, তেল, গ্যাস, আটা, চিনি, মাছ, ডিম থেকে শুরু করে শাক-সবজি এমন কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই, যার দাম বাড়েনি বা বাড়ছে না। বাজারজুড়ে মিলছে শীতের সবজি। কিন্তু ভরা মৌসুমেও তার দাম আকাশ ছোঁয়া। সিম, মিষ্টি আলু ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর এই সময় ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি। চালের দামও ভরা মৌসুমে ঊর্ধ্বমুখী। সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলছে না। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। হতাশায় নিমজ্জিত খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও।

করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই, অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সঙ্কোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে অনেকের।

নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি গরীব, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনকে রীতিমত দুর্বিসহ করে তুলছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।

নগরীরর ময়লাপোতা সন্ধ্যা বাজারের সুমি স্টোরের মালিক কাউসার বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা যেমন ক্ষীপ্ত, তেমনি আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। সাধারণ মানুষ বাজারে এসে দাম শুনে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু না কিনে চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

বড় বাজারের মুরাদ ট্রেডার্সের ম্যানেজার জিয়াউল হক মিলন বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিনিয়তই চাল, তেল ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়াছে। ২০২০ সালে সয়াবিন তেল প্রতি কেজির পাইকারি দাম ছিল ৮৮ টাকা, ২০২১ সালে ১১৫ টাকা ও  চলতি বছর ১৬০ টাকা।   ২০২০ সালে পাম ওয়েল ছিল ৬৪.৫ টাকা, ২০২১ সালে ৯০ টাকা ও  বর্তমানে ১৪৯ টাকা। ২০২১ সালে মোটা মসুর ডালের দাম ছিল কেজি ৬৮ টাকা, ২০২২ সালে ৮৯ টাকা। ২০২১ সালে দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ৯২ টাকা, বর্তমানে ১০৮ টাকা। ২০২১ সালে বিদেশি চিনির দাম ছিল ৫৬ টাকা, বর্তমানে ৭২ টাকা। ২০২১ সালে আটার দাম ছিল ২২ টাকা ২০২২ সালে ৩১ টাকা। ২০২১ সালে লবনের কার্টুনের দাম ছিল ২৭০ টাকা আর বর্তমানে ৩৯০ টাকা।

খাসা-অর্গানিক পণ্যের মালিক মো. হেলাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ধারাবাহিক ভাবে সবধরনের তেলের সঙ্গে বাড়ছে সরিষার তেলের দামও। ২০২০ সাল থেকে এই সরিষার তেলের দামের কোন ধারাবাহিকতা নেই। সয়াবিন তেলের দামের সঙ্গে এই তেলেরও দাম বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা সরিষার তেল ব্যবহার করেন। করোনার প্রকোপ বাড়লে সরিষার তেলের ব্যবহারও বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই তুলনায় যোগান না থাকায় সরিষার তেলের দাম বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।   ২০২০ সালের শুরুতে সরিষার তেলের লিটার ছিল ১৬০ টাকা যা মঙ্গলবার  মানভেদে ২১০-২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খুলনার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, উৎপাদনের উৎস থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত অনেক স্তর রয়েছে। উৎপাদনকারী ন্যায্য মূল পাচ্ছে না। অথচ ভোক্তাকে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যসত্বভোগী একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া বিপনন ব্যবস্থা দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্থ থাকায় সাধারণ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। পুরো বিপনন ব্যবস্থার মধ্যে যে অব্যবস্থা রয়েছে তা সরকারকে দূর করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮ , ২০২২
এমআরএম/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।