কক্সবাজার: ‘আমার শ্বশুরের শ্রাদ্ধ হওয়ার কথা বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি)। এ উপলক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
স্বামীর মরদেহের পাশে বিলাপ করতে করতে এমন আর্তনাদ করছিলেন নিহত অনুপমের স্ত্রী পপি। শুধু তিনি নন, স্বামী হারানোর নয় দিনের মাথায় একসঙ্গে পাঁচ সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর মানু বালা। শোকে স্তব্ধ মানু বালা কান্না করতে করতে যেন তাঁর চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। এতটাই শোকাহত তিনি কান্না করতেও যেন পারছেন না আর।
আরও পড়ুন>>চকরিয়ায় পিকআপভ্যান চাপায় ৪ ভাই নিহত
মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজরা ইউনিয়নের মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কক্সবাজারমুখি একটি মিনি ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই চারজন, পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরেকজনের মৃত্যু হয়। এরা পাঁচজনই আপন ভাই। নিহতরা হলেন- মৃত সুরেশ চন্দ্র শীলের ছেলে অনুপম (৪৮), নিরুপম (৪৫), দীপক (৪০), চম্পক (৩৮) ও স্মরণ (৪৬)। মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ির উঠানে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় পাঁচজনের মরদেহ। পাশেই বিলাপ করে কাঁদছেন তাদের স্ত্রী। ছোট ছেলে-মেয়েরা কান্নাকাটি করছেন সমানতালে। তাদের আর্তনাদে যেন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে এসেছেন মরদেহ দেখতে। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনায় প্রতিবেশি, আত্মীয় ও স্বজন যেন সবাই হতবিহ্বল।
চকরিয়া সঙ্গীত নিকেতনের অধ্যক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ কুমার সুশীল বাংলানিউজকে বলেন, প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র সুশীল ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী। ১০ দিন আগে গত ২৮ জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। আজ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে তার ক্ষৌরকর্ম ছিল। এই কর্ম পালন করার জন্য তাঁরা নয় ভাই ও বোন ভোরে মহাসড়কের পূর্ব পাশের বনে গিয়েছিলেন। এ কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য মহাসড়কের পাশে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপর ঘরে পৌঁছে বাকি কর্ম সেরে তাঁরা বাবার শ্মশানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে কক্সবাজারমুখী একটি মিনি ট্রাক মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়ে তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই চার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। বিকেল তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক ভাই স্বরণ মারা যান। তিনি আরও জানান, এ সময় অল্পের জন্য প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছেলে প্লাবন (১৯) ও মেয়ে মুন্নী (২৮)। প্লাবন এবার ডুলাহাজারা কলেজ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পাগলপ্রায়।
মর্মান্তিক এ ঘটনায় শোকে বিহ্বল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মস্পর্শী। আসলে এই মুহূর্তে তাদের সান্তনা দেওয়ার ভাষা ও হারিয়ে ফেলেছি। একটি দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গেল অনেকগুলো জীবন!
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, এ দুর্ঘটনায় আমরা সবকিছু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করছি। পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের চাপা দেওয়া গাড়ি ও ড্রাইভার-হেলপারকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন>>>চকরিয়ায় ৪ ভাইয়ের পর আহত আরও এক ভাইয়ের মৃত্যু
চকরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর এখনও শ্রাদ্ধ হয়নি। এর মধ্যে একসঙ্গে চলে গেল পাঁচ সন্তান! এটা সৃষ্টিকর্তার একটা কঠিন পরীক্ষা। পরিবারটি এ শোক কীভাবে সইবে বুঝতে পারছি না। বিশেষ করে বৃদ্ধ মা।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানিয়ে ইউএনও বলেন, এ পরিবারের জন্য এটি অপূরণীয় ক্ষতি। সৃষ্টিকর্তা যেন পরিবারের সদস্যদের এ শোক সইবার শক্তি দেন, সেই কামনই করি।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২২
এসবি/এএটি