ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পদ্মায় নাব্যতা সংকট, ব্যাহত নৌ চলাচল 

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২
পদ্মায় নাব্যতা সংকট, ব্যাহত নৌ চলাচল 

ফরিদপুর: চলতি শুষ্ক মৌসুমে ফরিদপুরের পদ্মা নদীতে হঠাৎ নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো, বলগেট ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

‍দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ নৌ বন্দরে ভিড়তে পারছে না। ফলে নৌ বন্দরের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। অন্যদিকে এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুণতে হচ্ছে।

জানা যায়, গত ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্যতা সংকটের কবলে পড়ে সিএন্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌঁছেছে। নাব্যতা সংকট রক্ষায় কমপক্ষে ১০-১৫ স্হানে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে। তবে খননের কাজ পরিকল্পিতভাবে করা না হলে অল্প দিনের মধ্যেই নৌ চ্যানেলগুলো নতুন বালু এসে ভারাট হয়ে যাবে বলে ঘাটের ছোট ও মাঝারি নৌযান মালিকরা মনে করেন।  

বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের ব্যবসায়িক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌ বন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌ বন্দর হিসেবে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থান থেকে নৌ পথে এই বন্দরে পণ্য আনা নেওয়া করা হয়। ফরিদপুরের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহি:বিশ্বে রপ্তানি হয়।  

এছাড়া সিলেট থেকে কয়লা চট্টগ্রাম থেকে সিমেন্ট, রাজশাহী থেকে বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, কমলঘাট, মিরকাদিম থেকে এই নৌ পথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর থেকে খালাস করা হয়।

কিন্তু বর্তমানে নদীতে নাব্যতা না থাকায় এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে ডিক্রীচর, ভূঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, পিঁয়াজখালী ঘাট, হাজিগঞ্জের চরহাজীগঞ্জের এলাকা, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙী ও গোপালপুরসহ বিভিন্নস্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো বলগেট ও বড় ট্রলার নদীর তীরে ভিড়ানো রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ মেঘনা ঘাট থেকে আগত সিমেন্টবাহী জাহাজের মাস্টার মো. সাকিল সেখ বলেন, চরে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনি। কিন্তু পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে ৮ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনতে হয়েছে। ৪ হাজার বস্তা সিমেন্ট কম আনতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুর ঘাটে আসতে প্রায় দুই কিলোমিটার চরের অস্তিত্ব মিলছে। তিনদিনের পথ আসতে ৫ দিন লেগে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এতে আমাদের পণ্যের ভাড়াও কমে গেছে। নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে প্রতি বস্তা থেকে ১৪ টাকা করে বাড়তি পেতাম। কিন্তু এখন এই ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি ট্রলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। এসব কারণে স্টাফ খরচ এবং অন্যান্য ভাড়াও বেড়ে গেছে। এছাড়া জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। পথে পথে চাঁদাবাজদের হানা।

এম বি শতনীড় নামে আরেকটি জাহাজের মাস্টার মো. কামাল বলেন, নাব্যতা না থাকায় জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ডুবো চড়ে ঠেকে যায়। তীরে ভিড়ানো যায় না  আটকে যায়। এতে চালু অবস্হায় জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়।  
তিনি বলেন, অন্তত গড়ে ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।

এখন জরুরি দরকার ড্রেজিং করা। পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং না করলে পুনরায় পলি পড়ে আবার গভীর করা জায়গা ভরে যায়।

পদ্মা কেন নাব্যতা হচ্ছে? এর কারণ জানতে চাইলে সেখানে ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্ত কয়েকজন বলেন, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন পলি ও বালু এসে ভরে যায়। পানিতে প্রচুর পলি থাকায় এ অবস্হার সৃষ্টি হয়েছে।

ফরিদপুর নৌবন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান টাইগার ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার মো. আব্দুল হাকিম বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক এই নৌ বন্দরে কাজ করতো। এর মধ্যে অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও রয়েছেন। কার্গো জাহাজ না আসায় তারা বেকার হয়ে রয়েছেন। কাজ পাচ্ছেন না।  

পদ্মা ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. রহমান জানান, বছরের ৫ মাস এখানে পানি কম থাকে বলে পণ্য খালাসে সমস্যা হয়।  

ফরিদপুরের সিএন্ডবি ঘাট থেকে শুল্ক আদায়কারী বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারী মো. রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বন্দরে জাহাজ, কার্গো, বলগেট, বড় ট্রলার ভিড়তে না পারায় তাদের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। তিনি জানান, আগে ঘাটটি ইজারা দেওয়া হতো। তবে এখন সরাসরি বিআইডব্লিউটিও এর লোকেরা শুল্ক আদায় করেন।

এ ব্যাপারে, বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট পোর্ট অফিসার মাসুদ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌ চ্যানেলে ড্রেজিং কাজ চলছে। তবে এই ঘাটটি এখনও পথটি বড় নৌযান চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। আশা করছি চলতি মৌসুমেই ঘাট পয়েন্টে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করলে এই সংকট কেটে যাবে।

বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলে ঘাটের কুলি শ্রমিকদের প্রবীণ নেতা মো. তারা মিয়া জানান, এই ঘাটে ১১টি কুলি সেক্টরে প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক ছিল। পদ্মার যৌবন থাকা অবস্হায় এই বন্দের প্রতিদিন ৩/৪ শত নৌযান ভিড়তো। এখন নাব্যতা সংকটের কারণে সপ্তাহ ১০/১৫টি বলগেট ৩/৪টি জাহাজ আসে। কাজ নেই। তাই কমপক্ষে ৭ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

ঘাট শ্রমিক ও ট্রান্সপোর্ট মালিকরা দুঃখ করে বলেন, সরকার এই ঘাটটি থেকে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেন। অথচ নিজস্ব কোন শৌচাগার নাই।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।