ঢাকা: সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়েছেন ট্রাকচালক মমিনুল ইসলাম মমিন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন তিনি।
স্ত্রী নার্গিসের হাত-পা এখন তার চলার সঙ্গী, বাঁচার সঙ্গী। দুই পা হারানোর কারণে বাথরুমসহ সব কাজ করতে হচ্ছে বিছানায়। এছাড়া যত রকম কাজ আছে তার সবই স্ত্রীর হাত ধরে করতে হচ্ছে মমিনুলকে। নিজের ভুলের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারাতে হয়েছে তাকে। পাশাপাশি আঘাত লাগে প্রস্রাবের রাস্তায় এবং খাদ্যনালীতেও।
বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে গিয়ে দেখা যায় ঢামেক হাসপাতালের পুরাতন ভবনের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন আছেন ট্রাকচালক মমিনুল। অর্থোপেডিক্স বিভাগেরর অধীনে তার চিকিৎসা চলছে।
মমিনুল ইসলামের বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চকদৌলত গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত আবদুল গনির একমাত্র সন্তান। চার বছর আগে মামাতো বোন নার্গিস আরাকে বিয়ে করে। তাদের একমাত্র সন্তান নুর ইসলামের বয়স মাত্র আড়াই বছর।
দু’চোখ ভরা জল নিয়ে মমিনুল বলেন, আমি অর্ধমৃত, আমার জীবনের সব শেষ। দুই পা হারানো মানে শরীরের কিছুই নেই। গত ৯ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের কাঁচপুর থেকে ১৪ টন রড ট্রাকে বোঝাই করে নওগাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সঙ্গে ছিল হেল্পার। রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে টাঙ্গাইল মহাসড়কে ট্রাক চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি। তখন প্রায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে চলছিল ট্রাকটি।
তিনি বলেন, এ সময় সামনের একটি ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পেছন থেকে আরেকটি ট্রাক তার ট্রাককে ধাক্কা দিলে ট্রাকের ভিতর চাপা পড়ি। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে। এ সময় তার দুই পা থেঁতলে যায়। এরপর প্রথমে তাকে নেওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতাল। সেখান থেকে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতাল। দিনভর পঙ্গু হাসপাতালে অবস্থান করার পর নেওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। সেই থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছি।
স্ত্রী নার্গিস জানান, ১০ জানুয়ারি ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বামীর দুটি পা ফেলে দেয়। এছাড়া ঘটনার সময় মুখমণ্ডলসহ প্রস্রাবের রাস্তার পাশাপাশি খাদ্যনালীতেও আঘাত পায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ট্রাকচালক মমিনুল বলেন, নিজের ভুলের কারণে আমার আজকে এই করুণ দশা। দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, পঙ্গু হয়ে গেলাম। সারা জীবন কাজ করে খেয়েছি। মানুষের কাছে হাত পেতে কোনদিনও খেতে পারব না। আমি নড়তে-চড়তে পারি না। আমার স্ত্রীর হাত-পা হচ্ছে এখন আমার হাত-পা। তানা হলে আমি অর্ধমৃত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকি। একমাত্র ছেলে গ্রামে স্ত্রীর বড় বোনের কাছে আছে।
নার্গিস জানান, আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আমার স্বামীর দুই পা হারালেও জীবনটা তো আছে। এখন থেকে আমি তার হাত-পা। আল্লাহ তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে দিক এই কামনাই করি। তাদের গ্রামে সম্বল বলতে কিছুই নেই। এ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার ডানপায়ে আরেকটা অস্ত্রোপচার লাগবে। এছাড়া আরও ছোট ছোট কিছু অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।
মমিনুলের মা মমেনা বেগম রাজধানীতেই থাকেন। বাসায় বাসায় কাজ করেন। তিনি ছেলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া ও সহযোগিতা চেয়েছেন।
আহতের বন্ধু মামুন বলেন, মমিনুল খুবই ভাল ছেলে। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকতো। এখন সে দুই পা হারিয়ে সারাদিন কান্নাকাটি করে। খালি বলে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ আমি পঙ্গু হয়ে গেলাম। আবার বলে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তোরা আমার বিকল্প পায়ের ব্যবস্থা করে দিস।
ঢামেক ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের অর্থোপেডিক্স ইউনিটি-২ এর অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার ডা.মো. মুরাদ হোসেন জানান, মমিনুলের অবস্থা এখন স্থিতিশীল আছে। তার ডান পায়ে আরেকবার অস্ত্রোপচার লাগবে। তার যতরকম চিকিৎসা প্রয়োজন সবকিছুই হাসপাতাল থেকে করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমাদের চিকিৎসকরা অন্য সব রোগীর মতো আন্তরিকভাবে তারও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু এটা সরকারি হাসপাতাল, তাই ওষুধপত্র বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ: ১৩০৭ ঘণ্টা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
এজেডএস/এমএমজেড