ফরিদপুর: ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের ধুলদী গোবিন্দপুর গ্রামের বারেক শেখের মেয়ে সাথী আক্তার (২৩)। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল প্রতিবেশী এক যুবককে।
প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিকসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন তিনি বাকরুদ্ধ। কেউ কথা বললে কোন সাড়া দেন না। খাওয়া দাওয়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদেহে অসংখ্য নির্যাতনের ভয়াবহতা নিয়ে ফেলছেন চোখের পানি।
সাথীর পরিবারের দাবি ভয়াবহ নির্যাতনসহ গাছ গাছড়ার ওষুধ খাইয়ে তাকে পাগল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনের পর দিন স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে নারকীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে তার জীবন যেন সংকটময়। মানসিক ভারসাম্য হারানো মেয়েকে নিয়ে বেশ সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে দরিদ্র ও অসহায় এ পরিবারটি।
গ্রামবাসী, থানা পুলিশ ও গৃহবধূর পরিবার জানায়, প্রায় ৮ বছর আগে ভালোবেসে প্রতিবেশী রাজু আহমেদকে বিয়ে করে সাথী আক্তার। বিয়ের পর বেশ ভালোই চলছিল রাজু-সাথীর সংসার। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই স্বামী রাজুর আসল রুপ ধরা পড়ে সাথীর কাছে। যৌতুকলোভী স্বামী টাকা-পয়সার জন্য নানাভাবে নির্যাতন চালায় সাথীর ওপর। মেয়ে ভালো চিন্তা করে সাথীর দরিদ্র পিতা-মাতা ধার কর্জ করে দুই লাখ টাকা তুলে দেয় রাজুর হাতে। কিন্তু কিছুদিন পর ফের ৫ লাখ টাকা দাবি করে রাজু। টাকা না দেওয়ায় শারীরিক ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতন অব্যাহত রাখে রাজু ও তার বাবা-মা। এরই মধ্যে সাথীর কোলজুড়ে আসে এক কন্যা সন্তান।
সেই সন্তানটির বয়স এখন প্রায় ৪ বছর। অবুঝ সন্তানটিকেও কেড়ে নেওয়া হয়েছে মায়ের কাছ থেকে। টাকা দিতে না পারার কারণে সাথীর ওপর চলতে থাকে ভয়াবহ নির্যাতন। দেহের বিভিন্ন স্থানে আগুনের ছ্যাকাসহ মারপিটের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে অসহায় এ গৃহবধূ। স্পর্শকাতর স্থান গুলোতে সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর সাথীর ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনের কথা শুনে সাথীর বাবা-মা ছুটে যান জামাই বাড়ীতে। সেখানে গিয়ে সাথীকে মারপিট করা হয়েছে এবং নির্যাতনের চিহ্ন দেখতে পান। পরবর্তীতে জামাই ও তার স্বজনেরা এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলে সাথীর বাবা-মাকে আশ্বস্ত করেন।
সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি মারাত্মক আহত অবস্থায় সাথীকে তার মা-বাবাসহ স্থানীয়রা স্বামীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সম্প্রতি তাকে বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়েছে। ধারাবাহিক নির্যাতন সইতে না পেরে সাথী এখন মারাত্মক অসুস্থ ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন কোন কথাই বলতে পারে না সে। চোখ থেকে শুধু জল ঝড়ছে। খাওয়া দাওয়া একপ্রকার বন্ধ। দরিদ্র পিতা হাসপাতালের চিকিৎসা করাতে না পেরে সাথীকে বাড়ীতে নিয়ে আসে। বর্তমানে বাড়িতেই চলছে সাথীর চিকিৎসা।
সাথীর ওপর অমানুষিক নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তার মা নুরজাহান বেগম বলেন, আমার মেয়ের ওপর নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবি জানাই।
এ বিষয়ে সাথীর বাবা বারেক শেখ বলেন, আমি একটি তেলের পাম্পে সামান্য বেতনের কর্মচারী। ফলে আমি মেয়ের জামাইয়ের যৌতুকের আবদার মেটাতে পারেনি। যার কারণে তারা আমার মেয়েকে নানাভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, সাথীর ওপর অমানুষিক নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, মেয়েটির বাবা-মা দরিদ্র হওয়ার কারণে তারা মেয়েটিকে নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। স্বামী ও শশুড় বাড়ির লোকজন মেয়েটিকে এমনভাবে নির্যাতন করেছে যা এ সভ্য দেশে কাম্য নয়। এছাড়া মেয়েটিকে আজেবাজে গাছ গাছড়া খাইয়ে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান তারা।
সাথীর ওপর নির্যাতনের বিষয় নিয়ে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার শালিস বৈঠক হলেও স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন শালিস মানেনি বলে অভিযোগ করেছেন সালিসে উপস্থিত থাকা কয়েকজন। উপরন্তু এসব বিষয় নিয়ে কিছু করা হলে হত্যাসহ গ্রাম ছাড়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
সাথীর ওপর বর্বর নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করে তার মা নুরজাহান বেগম বাদী হয়ে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার পর থেকে সাথীর স্বামী রাজ আহমেদসহ তার পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। যার কারণে অভিযুক্ত স্বামী রাজু ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অভিযুক্তদের কোন বক্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ জলিল বলেন, সাথীর উপর নির্যাতনের মামলার বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২
এনএইচআর