বগুড়া: বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলাকে ঘিরে লাখো মানুষের মিলনমেলা ভাঙল বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাতে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইছামতির তীরে পোড়াদহ এলাকায় এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রায় ৪০০ বছর আগের ঘটনা। মেলাস্থলে ছিল একটি বিশাল বটবৃক্ষ। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পূণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। প্রতিবছর মাঘের শেষে ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সমাগত হন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। কালের আবর্তে স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবে গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার। ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষের মেলবন্ধনে পরিণত হয় এই মেলা। মেলার প্রথমদিন থাকে মাছের দখলে। দ্বিতীয়দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একই স্থানে বসে বউমেলা। দিনব্যাপী চলে নারীদের কেনাকাটা গল্প আর আড্ডা। সেসঙ্গে উৎসবের আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী। নতুন জামাই-বউ ও স্বজনরা মিলে এ উৎসব করেন।
এবারের মেলা শুরু হয়েছিল বুধবার (০৯ ফেব্রুয়ারি)। বৃহস্পতিবার শেষদিন সন্ধ্যায়ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা জামাই, স্বজন, দর্শনার্থী, ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদভারে মুখরিত ছিল মেলা প্রাঙ্গন।
মেলায় আসা সুজন মাহামুদ, তৌফিক হাসান, মেদেহী শেখ, তানসেন খানসহ কয়েকজন ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর আমরা এ মেলায় মাছ কিনতে আসি। এবারো এসেছি। এদের মধ্যে সুজন মাহামুদ ২০ কেজি ওজনের একটি ব্লাককার্প মাছ কিনেছেন।
তারা বলেন, ঈদ ও পূজার পরেই এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম বড় উৎসব এ মেলা। মেলা উপলক্ষে পোড়াদহসহ আশেপাশের ২০-৩০ গ্রামের মানুষজন তাদের স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রণ তালিকার শীর্ষে থাকে নতুন-পুরনো জামাই বাবুদের নাম। এসব গ্রামের লোকজন জামাই-মেয়ে ও স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে সবাই মিলে-মিশে মেলার আনন্দ উৎসব ভাগাভাগি করে উপভোগ করেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সেলামির সঙ্গে জামাইরা নিজেদের টাকা মিলিয়ে মেলায় ওঠা বড় বড় মাছ ও রকমারি মিষ্টান্ন সামগ্রী কেনেন। এসব নিয়ে চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। পরে ধুমধাম করে সেই মাছ রান্না হয়। এরপর চলে আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া।
মেলার প্রথম দিন সবাই মাছ-মিষ্টি কেনায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন। দ্বিতীয় দিনের বউমেলায় নারীদের রকমারি খেলনা আর কসমেটিকস সামগ্রী কিনতে দেখা গেছে।
মেলার শেষ দিন বউ মেলাতে আসেন জারিফ জেরী, সামাইয়া হক, মৌসুমী, সেজুথী। তারা বাংলানিউজকে জানান, পোড়াদহ একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। এ মেলায় প্রথমদিন পুরুষদের প্রচণ্ড ভিড় থাকে। এদিন মাছ-মিষ্টি বেচা-বিক্রিতে লাখো মানুষের ঢল নামে। এ কারণে মেলায় যাওয়া হয়ে ওঠে না। পরদিনের মেলা শুধুই নারীদের জন্য বলে নারীদের উপস্থিতিটাই মুখ্য। বউমেলায় পুরুষ মানুষ আসে না। মেলার রীতি অনুযায়ী এদিন মেলায় পুরুষদের আসতে মানা। তাই তাদের জন্য সুবিধা হয়। তারা মেলায় আসেন। ঘোরাঘুরি করেন। স্বজনের সঙ্গে গল্প করেন। আড্ডা দেন। সঙ্গে পছন্দের প্রিয় জিনিসগুলো ক্রয় করেন।
তারা বলেন, এ মেলা থেকে প্রত্যেক বছর তারা বিভিন্ন কসমেটিক ও ইমিটেশন সামগ্রী কেনেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য খেলনা ও সাংসারিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়-এমন সব জিনিসপত্রও ক্রয় করেন।
মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছি। অপসংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করছে। গ্রামীণ এসব মেলা আজো বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস-ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এর মধ্যে পোড়াদহ মেলাটি অন্যতম।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে বড় আকৃতির বাঘাইর মাছ। তবে এ বছর মহাবিপন্ন বাঘাইর মাছ প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করতে মেলার আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠি দিয়েছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
চিঠিতে বলা হয়- বাঘাইড় মাছ একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠেয় পোড়াদহ মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন- ২০০২ অনুযায়ী মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় ক্রয়-বিক্রয় করা হলে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এ বছর মেলার প্রথম দিনেই সবার নজর কাড়ে ২০ কেজি ওজনের কাতলা ও ব্লাককাপ মাছ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২
কেইউএ/এনটি