বাগেরহাট: করোনাকালে হঠাৎ দরপতনে লোকসানের মুখে পড়েন বয়লার মুরগির খামারি কলেজ শিক্ষার্থী শেখ মেহেদী হাসান। হতাশা কাটাতে শখের বশে ঘরে থাকা ইনকিউবেটরে কোয়েলের ডিম ফোটানোর চেষ্টা করেন।
খামার থেকে মেহেদীর মাসিক আয় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। মেহেদীর স্বচ্ছলতা দেখে এলাকার অন্যরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে কোয়েল চাষে। মেহেদীর মত তরুণ উদ্যোক্তাদের কোয়েল চাষে উৎসাহ দিতে নতুন বাজার সৃষ্টিতে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
বাগেরহাট সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামে পিচঢালা রাস্তার পাশে মেহেদী হাসানের বাড়ি। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে রয়েছে পুকুর। পুকুরের পাড়েই গোলের ছাউনির ঘর। ওই ঘরের পেছনে রয়েছে আরও একটি পুকুর। পুকুরের মধ্যেখানে আরও একটি ঘর। দুই ঘরে থাকে মেহেদী হাসানের কোয়েল পাখি। ডিম এবং মাংসের জন্য পালন করা হয় আলাদা আলাদাভাবে। বাবা শেখ সরোয়ার হোসেন, মা নার্গিস বেগম ও স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী বোন মরিয়াম খাতুন সবাই মিলে কোয়েলের যত্ন করেন পরম আদরে। বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার ডিম ও সপ্তাহে চার হাজার পাঁচশ কোয়েল বিক্রি করেন মেহেদী। প্রতিটি ডিম ২ টাকা থেকে ২ টাকা ৫ পয়সা এবং কোয়েল ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় পাইকারি দরে। সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয় মেহেদীর। মেহেদীর এমন উদ্যোগে খুশি পরিবারের সবাই।
মেহেদীর বাবা শেখ সরোয়ার হোসেন বলেন, সংসার চালাতে ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। কিন্তু ছেলে কোয়েলের চাষ শুরু করার পরে বাড়িতে ফিরে আসি। সবাই মিলে কোয়েল পালন করে আমরা ভাল আছি। এখন আর আমার বাইরের কাজ খুঁজতে হয় না।
মেহেদীর বোন সরকারি পিসি কলেজের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী মারিয়া খাতুন বলেন, পড়াশুনার পাশাপাশি ভাইয়ার ফার্মে সহযোগিতা করি। বিশেষ করে ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো, ডিম এবং মাংসের জন্য বাচ্চা বাছাইয়ের কাজ করে থাকি আমি। এতে আমার সময় যেমন ভালো কাটে, তেমনি ভাইয়ারও সহযোগিতা হয়।
মেহেদীর মা নার্গিস বেগম বলেন, রান্না ও ঘর গোছানোর বাইরে আমাদের অবশিষ্ট সময় কাটে কোয়েলের ফার্মে। প্রতিদিন খাবার-পানি দেওয়া, পানির পাত্র পরিষ্কারসহ নানা কাজ রয়েছে। একজন মাত্র কর্মচারী আর ছেলে পেরে ওঠে না। তাই আমরা সবাই ওকে সহযোগিতা করি। কোয়েলের যত্ন করতে আমাদেরও ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন ফার্ম থেকে বাস্কেটে ডিম ওঠাই তখন খুব ভালো লাগে।
মেহেদীর কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে কোয়েল পালনকারী বাগেরহাট সদর উপজেলা ফতেপুর গ্রামের মো. সুমন বলেন, লোকমুখে শুনে কাশেমপুর এলাকায় সুমন ভাইয়ের খামার দেখতে যাই। খামার দেখে ভালো লাগে। পরে তার কাছ থেকে কিছু বাচ্চা এনে আমিও কোয়েল পালন শুরু করি। বর্তমানে আমার খামারে প্রায় তিন হাজার পাখি রয়েছে। এই খামার থেকেই আমার জীবনে স্বচ্ছলতা এসেছে।
শুধু সুমন নয়, ফতেপুরের ইয়াছিন, রাকিব, ফুলতলা এলাকার রবিউল, সোহাগসহ বেশ কয়েকজন যুবক মেহেদীর কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে কোয়েলের খামার শুরু করেছেন।
খামার মালিক শেখ মেহেদী হাসান বলেন, প্রায় ১২০০ মুরগির খামার ছিল আমার। কিন্তু রোগে মৃত্যু ও দাম কমে যাওয়ার কারণে আমি প্রায় সাত লাখ টাকার ঋণী হয়ে যাই। একপর্যায়ে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে কোয়েল চাষ শুরু করি। বর্তমানে খাবারের দোকানের দেনা প্রায় সব শেষ করে দিয়েছি। আশাকরি কোয়েল চাষের মাধ্যমে একটি ভালো যায়গায় যেতে পারব আমি।
কোয়েল পালন ও ব্যয় সম্পর্কে মেহেদী হাসান বলেন, ডিম থেকে ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ১৬ দিন। একটি বাচ্চা মাংসের উপযোগী হয় ২৭-২৮ দিনে। বাচ্চা থেকে ডিম পারা শুরু করে ৪৫-৫০ দিনের মাথায়। প্রতিটি কোয়েলের পেছনে দিনে ৪৫ থেকে ৫০ পয়সার খাবার ব্যয় হয়। এর সঙ্গে কর্মচারী, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুসঙ্গিক নানা ব্যয় রয়েছে। কোয়েল ও ডিমের দাম কিছুটা বাড়লে হয়ত আরও বেশি লাভ করতে পারতাম আমরা।
মেহেদী আরও বলেন, কোয়েল পালনের সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে এর জন্য কোনো ওষুধ লাগে না। রোগ হওয়ার আগেই কোয়েল বিক্রি করা যায়। যেকোনো পরিবেশে খুব অল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে কম জায়গায় কোয়েলের চাষ করা যায়।
বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমান বলেন, কোয়েল পাখির মাংস ও ডিম গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস ও হাই ব্লাড প্রেসারের রোগীদের জন্য এই পাখির ডিম খাওয়া বেশি উপকারী। তবে স্থানীয়ভাবে এই পাখির বাজার এখনও তেমনভাবে তৈরি হয়ে ওঠেনি, বর্তমান যারা খামারি রয়েছেন তাদের জন্য বাজারের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মেহেদীর মত আরও যুবকরা যদি কোয়েল পালনে এগিয়ে আসন, তাহলে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২
আরএ