ঢাকা: মেরিন ক্যাডেটরা শুধু সমুদ্রচারী নয়, তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেরিন ক্যাডেটদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তোমরা শুধু নির্ভিক সমুদ্রচারী নও, তোমরা বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তোমারা দেশপ্রেম, সততা, আত্মবিশ্বাস ও পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করবে। যখন এক দেশের পণ্য আরেক দেশে জাহাজে বয়ে নিয়ে যাবে, তোমরা বাংলাদেশের হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতি তুলে ধরবে। তোমাদের সততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা ভবিষ্যত ক্যাডেটদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।
রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ৫৬তম ব্যাচের ক্যাডেটদের ‘মুজিববর্ষ গ্র্যাজুয়েশন প্যারেড’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিহিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিজয়ী ক্যাডেটদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় বিবেচনা করে ’৭১-এর নভেম্বরের প্রথমার্ধেই পাকিস্তান সামরিক জান্তা কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত ‘মার্কেন্টাইল মেরিন একাডেমিকে’ করাচিতে স্থানান্তর করে। জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একজন বাংলাদেশিকে কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন পোতা ছিল, সেই মাইন অপসারণ করান বঙ্গবন্ধু। রশিয়া থেকে স্কোয়াড নিয়ে এসে এই মাইন অপসারণ করা হয়। এতে রাশিয়ার দুই জন্য সৈনিক জীবন দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) বৃটিশ কারিগরি সহায়তায় ‘ডেভলপমেন্ট অব মেরিন একাডেমি ১৯৭৩’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পূর্বের ৬০ একর আয়তনের সঙ্গে আরও ৪০ একর জমি অন্তর্ভুক্ত অধিভুক্ত করে একাডেমির মোট আয়তন ১০০ একরে উন্নীত করেন। ১৯৭৩ সালের ২১ মে মোট ১৬ জন ক্যাডেট এই একাডেমি থেকে স্বাধীন দেশের প্রথম, অর্থাৎ সম্মিলিত নবম ব্যাচ ডিগ্রি লাভ করে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চট্টগ্রাম সমুদ্র-বন্দরকে মাইনমুক্ত করেন, এবং মুক্তিযুদ্ধকালে নিমজ্জিত জাহাজগুলো সরিয়ে কর্ণফুলী চ্যানেলকে নিরাপদ ও চলাচলের উপযোগী করেন। তিনি বাংলাদেশি মেরিনারদের যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটিশ বৃত্তি চালু করেন; তিনি চট্টগ্রাম ড্রাইডক অ্যান্ড হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের নির্মাণকাজ শুরু করেন- সে সময় ১০০০ টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ তৈরি হয়। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়ে বিএসসির জন্য ১৯টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করেন এবং আরও ৯টি জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা জাপান সফরের সময় ৪টি নতুন সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নেন, যেগুলো তার প্রয়াণের পর সরবরাহ করা হয়। একই বছর তিনি রাশিয়ার সহায়তায় ‘মেরিন ফিশারিজ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খুলনা শিপ-ইয়ার্ডে বড় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সূচনা করেন। তিনি বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেন এবং ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম আইন, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। তিনি সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস্ অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন, যা ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন কনভেনশন গ্রহণে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
মেরিন একাডেমির উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর জাতির বুকে চেপে থাকা সামরিক-অসামরিক নানা পোশাকের হিংস্র স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা মেরিন একাডেমিতে নতুন গভর্নিং বডি অনুমোদন দেই এবং যুগোপযোগী কারিক্যুলাম গ্রহণ করি। আমাদের সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগের ফলে এসটিসিডব্লিউ-৯৫ কনভেনশনের সকল শর্ত পূরণ করে আমাদের একাডেমি আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থার সাদা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
মেরিন একাডেমির ৫৬তম ব্যাচের ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমরা অনেক প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। সমুদ্রচারণ কোনো সাধারণ পেশা নয়, এ পেশায় আত্মনিয়োগ করলে সমুদ্রের প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য পরিবহণ সমুদ্র পথেই হয়ে থাকে। তাই বিশ্ব অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে মেরিন ক্যাডেটদের ভূমিকা অপরিসীম। জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ শিল্পায়নের যন্ত্রপাতির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর পরিবহন বিঘ্নিত হলে গোটা বিশ্বই স্থবির হবে। বৈশ্বিক মহামারির কারণে বহু সংখ্যক মেরিন অফিসার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা সমুদ্রে আটকা পড়েছিল। তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েনি। দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, আমরাও করোনাকালে অবিরাম দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, মেরিন অফিসার/ইঞ্জিনিয়ারদের ‘কি-ওয়ার্কার’ হিবেবে স্বীকৃতি দিয়েছি।
মেরিন ক্যাডেটরদের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই, শুধুমাত্র বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির প্রায় পাঁচ হাজার প্রশিক্ষিত ক্যাডেটর সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রতি বছরে আমাদের অর্থনীতিতে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্ত করে থাকেন। তাছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক পরিসরে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে তারা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে থাকেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা উদ্ভাবনী গবেষণার মাধ্যমে মেরিটাইম খাতের উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। কেননা, বৈশ্বিক বেস্ট প্রাক্টিসেস, সম্পদের সহজলভ্যতা এবং প্রযুক্তিজ্ঞানের বিনিময়ের মাধ্যমেই এই খাতকে বর্তমান অবস্থা থেকে একটি সবুজতর ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই সংস্থাটি সবুজতর শিপিং এর জন্য নব নব প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আমি আশা করি, আগামী দিনের হাইটেক সমুদ্র জাহাজ পরিচালনার উপযোগী পেশাদার ক্যাডেট তৈরিতে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২
এসকে/এমজেএফ