ফরিদপুর: অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ফরিদপুরের ৫০০ বছরের ঐতিহাসিক স্থাপনা বাসুদেব মন্দির। অবহেলা অনাদর ও সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে মন্দিরটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
স্বাধীনতার আগে জেলার ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের খাটরা নামক গ্রামে মন্দিরটির স্থাপনা থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ সালের দিকে সেটি স্থান্তরিত করে পাশের প্রাণপুর (পরানপুর) গ্রামে স্থাপন করা হয়।
শতবছরের ঐতিহ্য বাঁচাতে প্রাণপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের মাখন লাল ভট্টাচার্য দেড় একর জমি দান করেন মন্দিরটি স্থাপনের জন্য। সরকারের কোনো অনুদান ছাড়াই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখায় চেষ্টা চলছে বলে দাবি মন্দিরটির সেবায় নিয়োজিত পুরোহিত জয়দেব কুমার ভট্টাচার্যের।
এই পুরোহিত আক্ষেপ করে বলেন, মন্দিরটির সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে অনুদান চেয়ে একাধিকবার আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে বারবারই প্রত্যাখান হতে হচ্ছে। ফলে এই মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, খাটরার হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘সরকার’ নামক গোত্রের জমিদাররা এই বাসুদেব মন্দিরটি প্রথম স্থাপন করেন ‘খাটরা’ গ্রামে। সেখানে মন্দিরটিতে কয়েকশত বছরের পুরনো সাড়ে চার মণ ওজনের কষ্টিপাথরের ‘বাসুদেব’ মূর্তি ছিল। দেশ স্বাধীনের আগে মন্দিরের কষ্টিপাথরের মূর্তিটি কয়েকবার চুরি হলে তা আবার ফিরে পাওয়া গেলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর মূর্তিটি চুরি হলে তা আর ফিরে পাওয়া যায়নি। চুরি হওয়া কষ্টিপাথরের মূর্তিটি আর না ফিরে পাওয়ায় এখন ৫০০ বছরের ঐতিহ্য মন্দিরটিতে সিমেন্টের তৈরি একটি ‘বাসুদেব’ মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মন্দিরটিতে এখন শতবছরের পুরনো একটি খাট ও কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। জয়দেব কুমার ভট্টাচার্য নামে একজন পুরোহিত সেখানে পূজা দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো দেখাশোনা করেন।
সরেজমিনে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাণপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের মাখন লালের দেওয়া দেড় একর জায়গায় ওপর নির্মিত মন্দিরটির চাল টিনের ছাউনি বেষ্টিত। চারদিকে খোলা। নেই কোনো প্রাচীর কিংবা বেড়া। মন্দিরটির পবিত্রতা রক্ষাতে নেই কোনো নিরাপদ বেষ্টনিও। মন্দিরটির ভেতর দিয়ে কুকুর-বেড়ালসহ জন্তু জানোয়ার অবাধে চলাচল করছে। কর্তৃপক্ষের মানা থাকা সত্ত্বেও মন্দিরের মূর্তির পাশের দেওয়ালে সাঁটানো হয়েছে স্থানীয় সমাজসেবক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পোস্টার।
এদিকে, মন্দিরটিতে প্রতিবছর জন্মাষ্টমী উপলক্ষে তিনদিন নামকীর্তন এবং দুই দিন পদাবলী হলেও করোনার পর থেকে দু'বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এই কীর্তন ও পদাবলীতে ৫-৬ হাজার মানুষের সমাগম হতো; তখন কিছু টাকা কালেকশন (চাঁদা) করে মন্দিরটির পরিচালনা ব্যয় করা হতো। এখন সেটাও বন্ধ থাকায় ও সরকারি কোনো অনুদান না পাওয়ায় মন্দিরটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া রাত্রে এখানে কোনো পুরোহিত কিংবা সাধু সন্নাসী না থাকায় মাঝে মধ্যেই চুরির ঘটনাও ঘটছে।
স্থানীয়রা জানায়, এই বাসুদেব মন্দিরটি থেকে প্রতিবছরই দোলযাত্রা, রথযাত্রা বের হয়ে থাকে। সেখানে শতশত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা অংশগ্রহণ করে। শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই মন্দিরটি।
প্রাণপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সমাজসেবক গৌতম ভট্টাচার্য বলেন, মন্দিরটির ইতিহাস ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব ধরে রাখতে অচিরেই সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। না হলে একদিন পুরোপুরি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে মন্দিরটি। তখন শুধু ইতিহাসেই শোভা পাবে মন্দিরটির নাম।
মন্দিরটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিতেই চন্দ্র শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, এটি ফরিদপুরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। যার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ৫০০ বছরের। কিন্তু এ ঐতিহাসিক মন্দিরটিতে সরকারের সুদৃষ্টি না থাকা বড় কষ্টদায়ক। আমরা আশা করি মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখতে সরকার এগিয়ে আসবেন।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দিনু বন্ধু ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে বলেন, মন্দিরটি আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারের সুদৃষ্টি না থাকার ফলে কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে প্রাচীন এই স্থাপত্য। যা সত্যিই দুঃখজনক।
তিনি বলেন, এখনও বহু মানুষ প্রত্যেক বছর প্রাচীন নিদর্শন এই বাসুদেব মন্দির দেখতে আসেন। তারাও মনে প্রাণে চাইছেন খাটরার এই প্রাচীন স্থাপত্যগুলি টিকিয়ে রাখতে একটু নজর দিক সরকার। তাহলে আরও বহু বছর টিকে থাকতে পারে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি। তা-না হলে অচিরেই ফরিদপুর তথা ভাঙ্গা উপজেলার ইতিহাস থেকে অচিরেই মুছে যাবে এই বাসুদেব মন্দিরের নিদর্শনগুলি, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিম উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, বাসুদেব মন্দিরটির পুরানো ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরে সঙ্গে কথা বলে যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, বাসুদেব মন্দিরে মাঝে মধ্যেই যে চুরির ঘটনা ঘটে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কাজ করবে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বাংলানিউজকে বলেন, এ মন্দির সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। আমি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। তবে আমরা এ ব্যাপারে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে মন্দিরটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে কাজ করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২
এনটি