ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনায় ভয়াবহভাবে বাড়ছে নৃশংসতা!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২
খুলনায় ভয়াবহভাবে বাড়ছে নৃশংসতা! প্রতীকী ছবি।

খুলনা: খুলনায় দিন দিন বেড়েই চলছে ভয়ংকর নৃশংসতা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটানো হচ্ছে হত্যাকাণ্ড।

দুর্বৃত্তের পাশাপাশি গর্ভধারিণী মায়ের হাতেও খুন হচ্ছে সন্তান। ধর্ষণের পর খুন করে মরদেহের ওপরও চালানো হয়েছে বর্বরতা। পৈশাচিক কায়দায় দেহ থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে মাথা মাটিতে পুঁতে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। যদিও অধিকাংশ অপরাধীদের হত্যাকাণ্ডের পর অল্প সময়ের মধ্যে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

গত এক মাসের অপরাধ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভয়াবহ তিনটি নৃশংস ঘটনা সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছে।  

২০ ফেব্রুয়ারি (রোববার) সকালে মহানগরীর বয়রা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (সিঅ্যান্ডবি কলোনি) দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র শুভ হাওলাদারকে (৯) ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে সজল ব্যাপারী (১৫) নামের এক কিশোর। হত্যা মামলার আসামি সজলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে সজল। তার দেওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তরিকুল ইসলাম রেকর্ড করেছেন। নিহত শুভ হাওলাদার সোনাডাঙ্গার হাফিজ কমিশনারের বাড়ির ভাড়াটিয়া ইব্রাহিম হাওলাদার ও ঝুমুর বেগমের একমাত্র সন্তান। আসামি সজল ব্যাপারী সোনাডাঙ্গা ময়লাপোতা মুনসুর খাঁর বাড়ির ভাড়াটিয়া নুর মোহাম্মদের ছেলে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সোনাডাঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুকান্ত দাস জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সজল বাবার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে ময়লাপোতা এলাকার একটি হোটেলে নাস্তা করে। পরে বালুর মাঠের দিকে খেলতে যায়। এ সময় সজল ওই স্থানে হাজির হয়ে শুভকে হিজড়া বলে ডাকতে থাকে। এতে শুভ ক্ষিপ্ত হয়ে সজলকে গালিগালাজ করে। পরে সজল ক্ষুব্ধ হয়ে শুভকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে প্রথমে লাথি মারে। এরপর ইট দিয়ে আঘাত করেন। ঘটনাটি জানাজানি হলে সমস্যা হতে পারে বলে সজল শুভকে ইট দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। এতেই শুভর মৃত্যু হয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) গর্ভধারিণী মায়ের হাতে সাত মাস বয়সী জমজ শিশু মুক্তা ও মনি হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে খুলনার তেরখাদায়। জমজ শিশু হত্যার দায় স্বীকার করেছেন মা কনিজ ফাতেমা কনা। শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন তিনি। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪- এর বিচারক মো. মোস্তাফিজুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

তেরখাদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মো. মাসুম কাজী বলেন, কানিজ ফাতেমা কনা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে স্বামী মাসুম বিল্লাহকে মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠায় কনা। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য স্বামীকে বলেন। মাসুমের মা অসুস্থ থাকায় বাড়িতে নিতে পারেননি কনাকে। পরে তাকে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। তাছাড়া জমজ শিশুর কান্নাকাটিতে তিনি বিরক্ত হতো। ওই দিন রাতে মেয়েদের দুধ খাওয়ানোর পর কান্না থামছিল না। অনেক কষ্ট করে তাদের ঘুম পাড়ানো হয়। রাত আড়াইটার পর ঘুম থেকে জেগে আবারও কান্না শুরু করলে তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তিনি। হত্যার পর কিছুক্ষণ শিশুটির কাছে অবস্থান করে তিনি। ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার সব পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। পরে পুকুরে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর দুই ঘণ্টা পর বাচ্চা নিখোঁজের নাটক সাজিয়ে চিৎকার করতে থাকেন।

২৫ জানুয়ারি খুলনার ফুলতলায় মুসলিমা খাতুন (২০) নামে এক তরুণীকে গণধর্ষণের পর গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তার শরীর থেকে জামা-কাপড় খুলে মরদেহের ওপর করা হয় পাশবিক নির্যাতন। পরে মাথা থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মাথা এবং দেহ ভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার চারদিন পর ধরা পড়ে দুই ধর্ষক ও হত্যাকারী। উদ্ধার হয় বিচ্ছিন্ন মস্তক এবং ওই তরুণীর পরনে কাপড় ও স্যান্ডেল।

ধর্ষণের পর তরুণী মুসলিমাকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় আসামি ফুলতলার যুগ্নিপাশা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ খন্দকারের ছেলে রিয়াজ খন্দকার ও শিলন সরদারের ছেলে সোহেল সরদার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে-২ জবানবন্দী দেন।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মুমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, পারিবারিক শিক্ষা এখন নেই বললেই চলে। এটা একটি কারণ। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে জিঘাংসা তৈরি হচ্ছে অনেকের মনের মধ্যে। আর একটি কারণ পুলিশের পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং কমে গেছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে টহল দিত তা কমে গেছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন বয়সীরা। মুসলিমাকে হত্যার যে মূল আসামি সে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। পারিবারিক শিক্ষা নেই আবার পারিবারিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে অপরাধ করে চলছে। আর একটি কারণ হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ বিচরণের কারণে এটা বেড়ে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা নেই। যে যে ধর্মেই থাকুক ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন আছে। স্কুল পর্যায়ে মূল্যবোধ তৈরি করার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। প্রথম হচ্ছে পরিবার। সন্তান কী করছে পরিবার খেয়াল করে না। পরিবার একেবারে ছেড়ে দিয়েছে তার সন্তানদের। এখান থেকে সন্তানরা সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। মাঝে শুভ নামে শিশুটিকে সজল সামান্য কথা কাটাকাটির পরিপ্রেক্ষিতে ইট দিয়ে থেঁতলিয়ে হত্যা করলো। কাজ না থাকা স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এসব অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি গাজী আলাউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের কাজের পিছনে আমার কাছে দুইটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো পারিবারিক যে সমস্যা রয়েছে অন্যটি হলো সামাজিক অবক্ষয়। ফুলতলার মুসলিমার কথা ধরি বা সোনাডাঙ্গায় ইট দিয়ে আঘাত করে শুভকে যে হত্যা করা হলো এ দুইটি ঘটনাকে আমার মনে হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের বলি এরা। অন্যদিকে তেরখাদার যে ঘটনাটা দুইটি বাচ্চাকে মা মেরে ফেললো আমি বিশ্বাস করি না কোন বাচ্চা কানলে মা বিরক্ত হয়। এটা কখনও বিশ্বাস যোগ্য নয়। যে মা সন্তানকে ৯ মাস পেটে রেখে জন্ম দেয় তার কান্নায় তো তাকে কষ্ট দেওয়ার কথা বিরক্ত হওয়ার কথা নয়। এটা পারিবারিক অশান্তি বা পারিবারিক যে সমস্যাগুলো আমাদের সমাজে রয়েছে তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। সামাজিক মূলবোধ ও পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ মানবাধিকার কর্মী।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. সামিউল হক বাংলানিউজকে বলেন, সামাজিক-পারিবারিক অস্থিরতা, কর্মহীনতা ও হতাশায় ধর্ষণ এবং খুনের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটছে। দিন দিন কেমন যেন সামাজিক বন্ধনগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। একটা সময়ে সমাজের একজনের ভালোতে সবাই আনন্দ পেতেন। নেতিবাচক দিকগুলো সমাজের লোকজন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতেন। এখন সে ব্যবস্থা উঠেই গেছে বললে চলে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। যে কারণে সামাজির অবক্ষয় রাড়ছে।

সামাজিক-পারিবারিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করেন ওই শিক্ষাবিদ।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।