সাভার (ঢাকা): মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল মনিরা ও সুমন হাওলাদার (২৮)। এরপই গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা থেকে আশুলিয়ায় এসে ইউনি ওয়ার্ল্ড ফুটওয়ার-২ নামের একটি কারখানায় ৫ মাস হলো কোয়ালিটি ইনচার্জের কাজ নেন সুমন হাওলাদার।
ভালোই চলছি বিবাহিত এই দম্পতির নতুন জীবন। কিন্তু হঠাৎ বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকালে কর্মরত অবস্থায় তাদের কর্মস্থল জুতার কারখানাটিতে আগুন লেগে যায়। আর মনিরা হাড়িয়ে ফেলে তার স্বামী সুমনকে।
কারখানাটিতে আগুন লাগার সময় মনিরাকে জানালা ভেঙে স্থানীয়রা বের করলেও ঘটনার পর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না সুমনের। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিভিয়ে ফেলার পর রাত ৯টার দিকে কারখানার সামনে এসে তার স্বামীকে খুঁজতে থাকেন মনিরা। এরপর রাত ১২ টার পর্যন্ত কান্না ও আহাজারি করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কাছে জানতে চান তার স্বামীর খোঁজ। কিন্তু স্বামীকে আরও পাওয়া যায়নি।
মনিরার সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্বামীর সঙ্গে আমার ৬ মাস হলো বিয়ে হয়েছে। আমাদের মত সুখী আর কেউ ছিল না। কারখানাটি এখানে শুরু ৬ মাস আগে। এর এক মাস পরেই আমার স্বামী এখানে কোয়ালিটি ইনচার্জের চাকরি নেয়। আমাদের বাসা কারখানার পাশেই। আর আমিও বাসায় বসে থাকি তাই ভেবেছিলাম তার অফিসেই চাকরি নিয়ে দুইজনে এক সঙ্গেই থাকবো। তাই গত মাসের ১৭ জানুয়ারি এখানে হেলপারের চাকরি নেই।
আগুন লাগার সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, যখন আগুন লাগে তার আগে আমি নিচে সিঁড়ির কাছে কাজ করছিলাম। আমার স্বামী দুই তলায় কাজ করছিলেন। আগুন লাগার ঘটনা জানতে পেরে আমি বাথরুমের ওদিকে চলে যাই। আর সুমন সিঁড়ির দিকে গিয়ে উপরে থাকা শ্রমিকদের নামানোর চেষ্টা করছেন। এতটুকুই দেখেছি আমি তখন। এরপর পুরো কারখানায় ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। আমি আর তাকে দেখতে পাই না।
তিনি আরও বলেন, কারখানার ভেতরে আগুনের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। আমি আরও কয়েকজন মহিলা জানালার কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে শ্বাস নেই। প্রায় ১০-১২ মিনিট পরে কয়েকজন এসে জানালা কেটে আমাদের বের করে। আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামী হয়তো প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ, বাসায় খোঁজ নিয়েছি সে সেখানেও যায়নি। পুলিশ একটা পুরুষের মরদেহ দেখালো কিন্তু সেটা এমন ভাবে পুড়ে গেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমার স্বামী কোথায় গেলো তাকে কেউ খোঁজে দেন।
এ আগুনে কারখানার ভেতরে আটকা পরে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে দুই নারী ও এক পুরুষের। দুই নারীর পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও পুরুষের শরীর পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়া তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
নিহত দুই নারী হলেন- টাঙ্গাইল জেলার মালতি গ্রামের ইমারত হোসেনে মেয়ে সুমাইয়া (১২) ও খুলনা জেলার পাইগাছা থানার খড়িয়া গ্রামের আব্দুল হামিদের মেয়ে সাহানারা বেগম (৪৫)।
অভিযোগ উঠেছে, আগুন লাগার পর বাইরে থেকে ফটক তালাবদ্ধ করে নিরাপত্তাকর্মী পালিয়ে যাওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, কারখানাটির কোনো অনুমোদন ছিল না। স্থানীয়রাও কারখানাটির বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়গুলো আমাদের জানিয়েছেন। এখানে অনেক শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হতো। এছাড়া কারখানা ঘুরে অগ্নিনির্বাপণ কোনো ব্যবস্থাও আমরা পাইনি। বিনা অনুমতিতে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তারা শিল্পায়ন করেছে।
তিনি বলেন, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। আমরা এ ধরণের অনুমোদনহীন কারখানা যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। ইতিমধ্যে আশুলিয়া থানা পুলিশকে এ ঘটনায় মামলা নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। পুলিশ কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে আর্থিক সহায়তা করা হবে। দুই নারীর পরিচয় শনাক্ত করা গেছে, আর পুরুষের শরীরের অংশ পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ পরিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের ৪ নম্বর জোনের উপ-পরিচালক আবদুল আলিম বলেন, আমরা ৮টি ইউনিটের চেষ্টায় অল্প সময়ের ভেতর আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছি। পরে আমরা দুই নারীসহ তিন মরদেহ উদ্ধার করেছি। তবে কত জন আহত সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় আমরা পাইনি। এদের মধ্যে দুইজন শ্বাসকষ্টে, আর একজন আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
এসএফ/এনএইচআর