মেহেরপুর: অভিশপ্ত একটি গ্রামের নাম ছিল মেহেরপুরের ‘ট্যাঙ্গার মাঠ’। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূর কুতুবপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম ট্যাংগার মাঠ।
চোরের গ্রাম থেকে সেই ট্যাঙ্গার মাঠ এখন প্রবাস গ্রাম হিসেবে পরিচিতি। গ্রামে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। অপরাধীর গ্রাম হিসেবে পরিচিত সেই ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের নামটিও পরিবর্তন করে এখন হয়েছে শিশিরপাড়া। মানুষকে কেউ এখন আর চোর, ডাকাত বা অপরাধী বলে গালি দেইনা। এই গ্রামের ঘরে ঘরে এখন ও সুখ ও শান্তির সুবাতাস। ছোটরা এখন চুরিবিদ্যা নয়, সবাই শিখছে লেখাপড়া। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এখন লেখা-পড়া করছেন চোরের গ্রাম নামে খ্যাত সেই ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের ছেলে-মেয়েরা।
কৃষক হজরত আলী, জাহিদুল ইসলাম ও রেবেকা খাতুন জানান, এক সময়কার আলোচিত ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের মানুষ অপরাধ জগত থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কেউ এখন ওদের নামের শেষে চোর কিংবা ডাকাত বলে না। এলাকায় বা আশে-পাশের গামে ডাকাতি কিংবা চুরি হলেও কেউ এখন আর খোঁজ করতে ট্যাঙ্গার মাঠে আসেনা। মানুষ সবাই এখন কর্মব্যস্ত। কেউ ব্যবসায়ি কিংবা কেউ দিন মজুর। এ গ্রামের গ্রামের প্রায় এক হাজার লোক সৌদি, ওমান, বাহারাইন, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে আছেন। তারা প্রতি মাসেই মোটা অংকের টাকা পাঠাচ্ছেন পরিবারের জন্য। প্রতিটি পরিবারেই এখন স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন। প্রতিটি পরিবারের সদস্যই এখন প্রবাসী। এক সময়ের চোরের গ্রাম এখন প্রবাস গ্রাম হিসেবে চেনে আশেপাশের জেলাবাসী।
কলেজছাত্র লিজন শাহ, স্কুলছাত্র রাসেল আহম্মেদ, শাহ আলম জানান, এই গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। এছাড়া পাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৬ জন কলেজে ৮ জন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন ছাত্র পড়া লেখা করছেন। প্রতিটি বাবা-মাই এখনই তাদের ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার ব্যাপারে সোচ্চার। লেখাপড়ার জন্য এখন অনেকেই শহরে গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানান তারা।
কথা হলো ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের সেই শীর্ষ ডাকাত বর্তমান মোয়াজ্জিন আকবর আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, আমাদের বাড়ি ছিল ভারতের করিমপুর থানার রহমতপুর গ্রামে। হিন্দুদের অত্যচারে ১৯৪৭ সালে আমরা স্বপরিবারে বাংলাদেশে এসে গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাজিপুর গ্রামে আশ্রয় নিই। সেখানেও আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে একটি গেষ্ঠি। পরে সেখান থেকে সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে চলে আসি।
এসময় এই এলাকার তৎকালীন হিন্দু জমিদার রাজলক্ষি গংদের কাছ থেকে মেহেরপুর থানাপাড়ার আনোয়ার হোসেন ও হজরত আলী ৭০০ বিঘা জমি বিনিময় সূত্রে তাদের কাছ থেকে নেন। ১৯৬৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারা বিনিময় সূত্রে নিলেও শ্যামপুর, বেলতলাপাড়া, ঝাউবাড়িসহ আশেপাশের লোকজন তাদের সেই জমি দখল দেইনা। পরে নজরুল ইসলাম আমাদের ৫০ জন লোককে ৫০ বিঘা জমি লিখে দেওয়ার শর্তে প্রথমে এই ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামে বসতি গড়ার প্রস্তাব দেন। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে গ্রামটিতে আমি জুলমত হোসেন, আলী হোসেন, তাহের আলী, আসমত আলী, আমির, আকবর আলী, মজিব আলী, এলকাত হোসেনসহ ৩০টি পরিবার বসবাস শুরু করে গ্রাম গড়ে তুলি। ওই সময় ভারত থেকে গরু চুরি করে আনতাম। পরে এক সময় এলাকার লোকজনের গরু চুরি করতো। পরে সব অপরাধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো এই গ্রাম থেকে।
সীমান্তের ওপারে ভারতে অপরাধ করতে যেয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ওই গ্রামের ১৫ জন ডাকাতের প্রাণ গেছে গণপিটুনিতে। এদের মধ্যে রয়েছেন আবু ডাকাত, আসমত ডাকাত, পঁচা ডাকাত, ছলিম ডাকাত, আবুজেহেল ডাকাত, ফড়িং ডাকাত।
১৯৮৮ সালে তৎকালীন মেহেরপুরের পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দীন ও জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন এই গ্রামের ডাকাত সর্দার আকবর আলী ও তার ডাকাত দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সব ধরনের সহযোগীতা ও মামলা থেকে রেহায় দেওয়ার আশ্বাস দিলে অপরাধ জগত থেকে ফিরে আসার ঘোষণা দেন অপরাধীরা। প্রাশাসনের সহযোগিতায় অপরাধ জগত থেকে ফিরে আসার শপথ নেন। তখন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ১ মণ করে চাল দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
গ্রামের লোকজন পুকুর খনন ও মাছ চাষের পাশাপাশি যুবকদের বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে গ্রামের ডাকাত সর্দার আকবর আলীকে সৌদি আরবে পাঠান। এরপর প্রতিটি বাড়ির লোকজনের সমন্বিত উদ্যোগে প্রতিবছর একজন করে বিদেশে পাঠাতে শুরু করেন। এখন গ্রামের অনেকেই বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছে। এখন আর তাদের কোনো অভাব নেই তারা এখন সবাই সাবলম্বী।
ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবেদ আলী বাংলানিউজকে জানান, বছর দশেক আগেও এ গ্রামের লোকজন তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইতো না। কিন্তু এখন এ গ্রামের সকল ছেলে মেয়েই স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। এখন গ্রামের কেউ অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত নন। সকলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
- অপরাধ বিশ্লেষক ও মেহেরপুর জেলা কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, মানুষ কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয়না। পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে অপরাধী হিসেবে সৃষ্টি করে। আমাদের সবার উচিত কেউ অপরাধী হয়ে উঠলে তাকে পারিবারিক, সামাজিকভাবে সহযোগীতা করে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা।
কুতুবপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেমবর) আনিছুর রহমান জানান, ওয়ার্ডটিতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৪২৫ জন। অর্ধেকের বেশি নারী ও বাকিরা পুরুষ ভোটার। গ্রামের প্রায় ১২শ’ মানুষ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। বাকিরা কৃষক, রাজমিস্ত্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২২
এনটি