ঢাকা: আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আনসার আল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মিশনে অংশ নেন সংগঠনটির অন্তত ১৭-১৮ জন সদস্য। এদের মধ্যে ৫-৬ জঙ্গি দুইটি মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে আসেন।
আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়ার (৪০) দিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় মিশনটি সম্পন্ন হয়।
পুলিশের চোখে-মুখে পিপার স্প্রে মেরে ও আঘাত করে দুই জঙ্গি পালিয়ে যেতে পারলেও পালাতে ব্যর্থ হন হেফাজতে থাকা আরও দুইজন। ওই দুই জঙ্গিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এমন তথ্যই জানতে পেরেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সূত্র জানায়, আনসার আল ইসলাম যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা ঘটনাস্থল রেকি করে থাকেন। এ ঘটনায়ও পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনাস্থল রেকি করা এবং তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে একাধিক টিম ঘটনাস্থল ও এর আশে-পাশে উপস্থিত ছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিশন সম্পন্ন করে পালিয়ে যান তারা।
রোববার (২০ নভেম্বর) এ ঘটনায় ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
ডিএমপির প্রসিকিউশনের পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ বাদী হয়ে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলাটি (নং-৩৩) দায়ের করেন।
মামলার এজহারে বলা হয়, ২০ নভেম্বর সিজেএম কোর্ট ভবনের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে ২০১৬ সালে ডিএমপির মোহাম্মদ থানায় হওয়া সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া একটি মামলায় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ১৪ আসামির হাজিরের দিন ধার্য ছিল।
এই ১৪ জঙ্গিরা হলেন- শাহিন আলম ওরফে কামাল (২২), শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিন (২৬), বিএম মজিবুর রহমান (২৭), মো. সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব ওরফে সিহাব ওরফে সাইফুল (২০), মইনুল হাসান শামিম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান (২৪), খায়রুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান (২৪), মো. আবু সিদ্দিক সোহেল (৩৪), মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সাইমন (২৫), মো.আরাফত রহমান (২৪), মো. শেখ আব্দুল্লাহ (২৭), মো. আ. সবুর ওরফে রাজু ওরফে সাদ ওরফে সুজন (২১), মো. রশিদুন্নবী ভূঁইয়া (২৬), মো. ঈদী আমিন (২৭) ও মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪)।
এদের মধ্যে মো. ঈদী আমিন (২৭) ও মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) জামিনে রয়েছেন।
২০ নভেম্বর সকাল আনুমানিক ৮টা ৫ মিনিটে কাশিমপুর কারাগার থেকে বাকি ১২ জন আসামিকে সিএমএম কোর্টের হাজতখানায় প্রিজনভ্যান করে নিয়ে আসা হয়। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে ডিএমপির ঢাকার প্রসিকিউশন বিভাগের পুলিশ সদস্যরা ১২ আসামিকে হাজিরার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যায়। মামলার শুনানি শেষে জামিনে থাকা আসামি ঈদী আমিন ও মেহেদী হাসান অমি আদালত থেকে বের হয়ে যান।
এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে মইনুল হাসান শামিম, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মো. আরাফত রহমান, মো. আ. সবুরকে হাজাতখানার নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয় স্কর্ট ডিইউটিতে নিয়োজিত অফিসার ও ফোর্স।
হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে সিজেএম কোর্টের মূল ফটকের সামনে পোঁছালে দুইটি মোটরসাইকেল করে আসা ৫-৬ জঙ্গি ও অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জন জঙ্গি পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশে তারা এ হামলা করা হয়।
মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, সন্ত্রাসী কাজে পুলিশ সদস্যরা বাধা দিলে লোহার বস্তু দিয়ে পুলিশ সদস্য মো. আজাদকে হত্যার উদ্দেশে মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করে এক জঙ্গি। কিন্তু আজাদ পেছনে সরে যাওয়ায় তার নাকে-মুখে আঘাতটি লাগে। এতে তিনি জখম হন। পরে পুলিশ সদস্য আজাদের ডাক চিৎকারে আশেপাশে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা মূল ফটকের দিকে এলে জঙ্গিরা তাদের লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে পালিয়ের যাওয়ার চেষ্টায় থাকা জঙ্গিরা। এতে ফটকের নিরাপত্তারক্ষী মো. তারেক জিয়া (২১) গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই সুযোগে অজ্ঞাত জঙ্গিরা আনসার আল ইসলামের সদস্য মইনুল হাসান শামিম ও আবু সিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। এ সময় অপর দুই জঙ্গি আরাফত রহমান ও সবুর আহত পুলিশ সদস্যদের কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে তাদের আটক করা হয়। এছাড়া শামিম ও সিদ্দিক মোটরসাইকেল করে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের পুলিশ ধাওয়া করে। সে সময় তারা একটি মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যান। পরে সেই মোটরসাইকেলটিকে জব্দ করে পুলিশ।
এজহার থেকে আরও জানা যায়, এজাহারনামীয় ও পলাতক আসামিরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধন, রাজনীতিবিদ, ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার মিশন বাস্তবায়নের জন্য জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে। এছাড়া ছিনতাই মিশনে জঙ্গিদের ফেলে যাওয়া একটি নীল-কালো রঙের মোটরসাইকেল ও ১৪.৫ ইঞ্চি লোহার কাটার ও একটি সাদা রঙের পলিথিনে রাখা বিভিন্ন সাইজের ৬৯টি লোহার নাট বল্টু জব্দ করেছে পুলিশ।
পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ দুই জঙ্গি আরাফত ও সবুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তারা আগে থেকেই জানতেন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার দিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনা মোতাবেক সংগঠনটির সদস্য আয়মান ওরফে মশিউর রহমান, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে আকাশ, তানভীর ওরফে সামশেদ মিয়া, রিয়াজুল ইসলাম ওরফে রিয়াজ ওরফে মো. ওমর ফারুক রোববার পুলিশের ওপর হামলা করে তাদের ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আনসার আল ইসলামের ৫-৬ জন জঙ্গি দুইটি মোটরসাইকেল করে এবং আরও ১০-১২ জন জঙ্গি আদালতের আশপাশে অবস্থান নেন। পরে সুযোগ বুঝে তারা হামলা করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যান।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিরা যে পথ দিয়ে পালিয়েছেন, সেটি ধরেই কয়েকটি টিম কাজ করছে। তাদের গ্রেফতারে নানা তৎপরতা চলমান রয়েছে। সড়কের আশে-পাশে তল্লাশিসহ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, তাদের গ্রেফতারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), সিটিটিটিসি’সহ বাংলাদেশ পুলিশের অন্যান্য ইউনিট মাঠে কাজ করছে।
এদিকে, এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় পালানোর চেষ্টাকালে আটক দু’জনসহ ১০ জঙ্গির ১০ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ২০ নভেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিন এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ছিনতাই হওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে মোহাম্মদপুর থানার যে মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল, এই ১০ জন একই মামলার আসামি। তাদের জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায়ও আসামি করা হয়েছে।
>> জঙ্গি ছিনতাই: আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
>> জঙ্গি ছিনতাই: ১০ জঙ্গি ১০ দিনের রিমান্ডে
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২২
পিএম/এসআরএস