ঢাকা: একাত্তরের ১ মার্চের আগেই পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের সাথে আলাপকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীন বাংলাদেশে’ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা (এইড) কিভাবে আসবে তা জানতে চেয়েছিলেন। বাঙালীর ওই সংগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানে মিলিটারি আগ্রাসন এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেবে কিনা সে প্রশ্নও করেছিলেন।
সিআইএ’র দেওয়া সে সময়ের রিপোর্ট দীর্ঘ ৪৩ বছর গোপন ছিলো। সদ্য প্রকাশিত ওই গোপন নথি বলছে, “মুজিবের মাথায় পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা ‘পরিস্কারভাবেই’ রয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জয়ী হতে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ”
নথিতে রয়েছে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান ‘স্বাধীন’ ঘোষণার কথা ৪ মার্চেরও আগে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এছাড়াও ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের পূর্ব পাকিস্তানী কর্মকর্তারাও ৭ মার্চেও আগেই যে স্বাধীন হলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলেছেন সে তথ্যও মিলেছে গোপন নথিতে।
ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দুই সদস্য হ্যারল্ড সন্ডার্স এবং স্যামুয়েল হসকিনসন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তারিখে পাঠানো একটি মেমোরেন্ডামে এসব কথা জানিয়েছিলেন।
এছাড়া পাকিস্তানে ১ মার্চের ঘটনাবলী পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার পথে ‘অগ্রিম পদক্ষেপ’র বলেও তারা উল্লেখ করেছেন ওই নথিতে।
মেমোরেন্ডামে পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের এ দুই সদস্য শেখ মুজিবের ঘোষিত আওয়ামীলীগের ছয়-দফার কথাও উল্লেখ করেন। তালে লিখেছিলেন, “মুজিব কেবল ‘নিবিড় ভাবে’ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন এবং স্বায়ত্ব শাসন প্রশ্নে কোন ধরনের সমঝোতা করতে নারাজ। কারণ, তিনি ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষে এবং ভারতের ব্যাপারে কট্টরপন্থী ইয়াহিয়া ও ভুট্টো’ দুজনেরই সাথে আবারো সংঘাতে জড়িয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়েছিলো, সমঝোতার সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ এবং মুজিব সহজেই এ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে, পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসার এটাই তার জন্য উত্তম সময়। তার মাথায় পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তাটা ‘পরিষ্কার। ’
মেমোরেন্ডামে এই বিষয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান’ সম্পর্কে পৃথক পংক্তিতে সিকিউরিটি কাউন্সিলের দুই কর্মকর্তা আরো লিখেছিলেন, “সবকিছুর পর এশিয়ার অস্থিতিশীল এই এলাকায় আমরা সম্ভাব্য নতুন একটি জাতির জন্মের সাক্ষী হতে চলেছি। যখন ‘নিয়ন্ত্রন’ বিষয়টি মুখ্য নয়, নবজাতকটি কিভাবে জন্ম নেবে- শান্তিপূর্ণ ভাবে নাকি রক্তাক্ত জনযুদ্ধের (সিভিল ওয়ার) মধ্য দিয়ে সেব্যাপারে আমাদের করনীয় কিছু থাকতে পারে।
এতে আরও বলা হয়, যদি তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে রক্তক্ষয় এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র কতখানি সক্রিয় হবে সেব্যাপারে প্রশ্নের উত্তরে ২৪ ঘন্টা সময়ের প্রয়োজন।
মেমোরেন্ডামে হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্যে বলা হয়, “এনএসএসএম ১১৮ এ জরুরি পরিকল্পনার নির্দেশ রয়েছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তা সম্পন্ন হবে। পরিকল্পনাটি হাতে পাওয়া মাত্রই পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় ‘সুপারিশ’সহ অনতিবিলম্বে আপনার কাছে পাঠাবো। ”
এছাড়াও ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দুই সদস্য হ্যারল্ড সন্ডার্স এবং স্যামুয়েল হসকিনসন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে ১৯৭১ এর ৪ মার্চ দেওয়া মেমোরেন্ডামের তৃতীয় পংক্তিতে লিখেছিলেন, মুজিব বৈদেশিক সংবাদদাতাদের অনেকের কাছে ‘অব দ্য রেকর্ড’ বলেছেন রবিবারে (সম্ভবত ৭ই মার্চ) তিনি স্বাধীনতা’র কথাই ঘোষণা দেবেন। যাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান তাদের নিজস্ব পৃথক সংবিধান রচনা করবে এমন কথাই থাকবে।
ওই মেমোরেন্ডামে আরও বলা হয়েছিলে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ মার্চে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতাদের কন্ফারেন্সের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে মুজিব কার্য্যত সুনির্দিষ্ট ভাবেই পূর্ব ও পশ্চিমের মানিয়ে চলার দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
পরের পংক্তিতে বলা হয়, ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের পূর্ব পাকিস্তানী কর্মকর্তারা একটি ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পরবর্তী সময়ে ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে তাদের রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তারা চ্যান্সেরি থেকে চাকুরিচ্যুত হবেন এবং বর্তমান ডিসিএম, যিনি একজন বাঙালী (পূর্ব পাকিস্তানী) তিনি ‘নতুন দূতাবাসের’ চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হবেন বলেও জানিয়েছেন।
মেমোরেন্ডামে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ওয়ার্কিং লেভেল’র পর্যালোচনার কথাও বলা হয়েছে , তাদের বিচার্যে “বিমান ও জাহাজে পশ্চিমা সৈন্যদের উপস্থিতি ও দ্রুত সামরিক হামলার মত যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীরা নতি স্বীকার না করে বরং আরো সহিংস জবাব দেবে। ”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রকাশিত আরেকটি গোপন নথিও বাংলানিউজের হাতে এসেছে। ১৯৭১ এর ১৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টকে একটি নোট পাঠান। এই নোটে তিনি লিখেছিলেন-
“.... পূর্ব পাকিস্তানী নেতার ৭ মার্চের পূর্ণ ভাষণ প্রাথমিক সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট এর চেয়ে অনেক কঠিন ইঙ্গিতই বহন করছে। এটা অবশ্যই প্রতীয়মান হয়েছে, তিনি একটা ‘কৌশল’ নিয়েছেন। ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ স¦াধীনতার খুবই কাছাকাছি কিছু একটা তা স্পষ্ট হয়েছে এবং সে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হবেন না।
কিসিঞ্জার তার এই নোটে আরও বলেন, ইসলামাবাদে আমাদের দূতাবাস মনে করছে, মুজিবের লক্ষ্য অপরিবর্তিত- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ‘অর্থনৈতিক মুক্তি। ’ যেটা এখনো মনে হতে পারে পাকিস্তানের মধ্যেই প্রাদেশিক পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। কিন্তু এটা বাহ্যিক। মুজিব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছেন এবং তিনি যে মুক্তির কথা বলছেন সেটা কেবল সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমেই আসতে পারে।
বাংলাদেশ সময় ২০৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৪