২০.
ফুলি বেশ বিরক্তই হলো। সে সেটা লুকানোর চেষ্টা করল না।
-এতো কথা বলেন ক্যান? জিনিস কিনলে কিনবেন, না কিনলে না। এতো কথার কি হইল!
আমি মুচকি হাসি। কোনও উত্তর দিই না। এমন অবাক মনে হয় মেয়েটি আগে কখনওই হয় নি। ফুলির বয়স আঠারো-উনিশ বছর হবে। শরীরের সম্পদ ধরে রাখতে পারছে না; দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে রূপ-যৌবন। আমি ওর ব্যবসা নষ্ট করছি নাকি বিপদে ফেলছি, সেটা বুঝতে পারছে না মেয়েটি। বিভ্রান্ত চোখে আবার জানতে চাইল:
-আসলে আপনি কি চান, কন তো? কুন মাল চান? ভিজা না শুকনা? নাকি মৌজের মাল চান?
চোখ টিপে হাসল ফুলি। বললো:
-শোনেন জনাব, কিছু জানার থাকলে শফি মামারে কন। আমার কাছে না। আমার বেশি কথায় কাম নাই।
ফুলি গাছতলার জটলাগুলোর একটির দিকে ইঙ্গিত করলো। যে জটলা শামীম আমাকে বিকালে দেখিয়েছিলেন। আমি শফি মামার খোঁজে চলে এলাম পাশের ধোঁয়াক্রান্ত জটলার ধারে। দার্শনিক কথার তুবড়ি ছোটানো এক বক্তার গলা শোনা গেল:
-বুঝলেন মিয়ারা। জীবন আর ধোঁয়া একই চিজ। কুনুডারেই ধরা যায় না। হে হে হে...।
-মামু ঠিকই কইছেন।
জটলার এক অর্ধমুদিত চোখের তরুণ সায় দেয়।
শফি মামাকে চিনতে কষ্ট হল না। কথক নিজেই শফি মামা। সবাই মামা ডাকছে। কমন মামা। এসব ক্যারেক্টার জীবনভর একই চরিত্রে অভিনয় করেন। শফি মামাও তাই। কখনও নানা হবেন না, ভাগ্নেও হবেন না, মামাই থাকবেন। বছর যাবে, মাস, দিন যাবে, লোক বদলাবে, তিনি থাকবেন মামাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচক্ষণ মামার চোখ পড়ল আমার দিকে। লাল টকটকে চোখ:
-মিয়া আপনে কেডা? আপনেরে তো আগে দেহি নাই ?
নেশায় থাকলেও হুস আছে মামার। ঠিকই টের পেয়েছেন। আমি জড়ানো গলায় নিরাবেগে বলি:
-আমি আপনার নতুন ভাগ্নে।
উত্তর শুনে মামা খুশি হয়েছেন:
-হে হে হে। ভালা বলছেন। হে হে হে।
হে হে হে-টা মামার মুদ্রাদোষ না দ্রব্য গুণে সৃষ্ট আবেগীজোশ, বুঝতে পারলাম না। মনে হলো, মামা এই নতুন ভাগ্নেকে গ্রহণ করেছেন। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। সমস্যা হলো, মামাকে ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ না কেউ কানে কানে কিছু বলছে। মামা ঝোলার মধ্য থেকে কিছু বের করে দিচ্ছেন। আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না জিনিসগুলো। এটা তো দেখছি কেবল ‘লেন’ হচ্ছে, ‘দেন’ হবে কখন? লেন-এর অপর অংশ দেন সম্পন্ন হতে দেরি হলো না। মোটরসাইকেলে দুই তরুণ এলো। মামা তাদের কাছে চলে গেলেন। এবার ‘লেন-দেন’ দুই-ই হলো। মামা না থাকলেও আসরের কোনও খেলাপ হচ্ছে না। কল্কে ঘুরছে হাতে হাতে। একজন লম্বা টান দিয়ে আরেকজনকে দিচ্ছে। আমার পালা এলো। টানের ভঙ্গি করে কল্কে চালান করে দিলাম। পেছনে থেকে কে যেন বললো, ‘লাইনে নতুন’। কথা শুনে হাসির চাপা লহরি শোনা গেল। মনে মনে হাসলাম। কথকের চেহার দেখার চেষ্টা করলাম না। মামা ফিরে এসেছেন:
-কও মিয়ারা, কও?
কে আর কি বলবে! মামাই প্রশ্ন করেন। মামাই উত্তর দেন। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করাটা বাত-কা-বাত। কথা জমানোর কৌশল। মামা মহা আধ্যাত্মিক সাধক। সব দেহতত্ত্ব আর আধিভৌতিক কথা। হঠাৎ কি যেন হলো। মামা ফুঁপিয়ে গেয়ে উঠলে, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দাই...দাই রে...মরিলে কান্দিস না আমার দাই...। ’ কিছু বলতে হলো না। আসরের সবাই কোরাস ধরল, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দাই...’। জীবন এতোটাই ক্লান্তিকর হয়ে গেছে যে, পারলে মরণের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে পারলে বাঁচে। হুমায়ূন আহমেদ মরার আগে এই গান গেয়ে সবাইকে মৃত্যুচিন্তার দার্শনিকতা উপহার দিয়ে গেছেন।
মধ্য রাতের দিকে একজন একজন করে উঠে গেল। আসরে এখন আমি আর মামা। মামা সাবধানী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি স্বাভাবিক গলায় বলি:
-মামা, আমার কিছু কথা আছে।
হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন তিনি:
-সন্ধ্যার পর আমি কথার উত্তর দিই না। যা জানার জানতে হবে দিনের আলোতে। এখন শুধু দেখতে থাক। চল।
মামা ভাবজগতের শীর্ষে চলে গেছেন। এখন সবাই তার কাছে ‘তুই’। বাহ্য জ্ঞানের ধারে কাছেও নেই তিনি। ঝোলা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অদ্ভুত ব্যাপার। তার পা একটুকুও টলল না। ওস্তাদ লোক। সন্দেহ নেই।
পার্কের বাইরে এসে তিনি একটি রিকসা নিলেন। কোনও দরদাম করতে হলো না। গন্তব্য বলতে হলো না। রিকসায় উঠে আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন:
-আয়।
আমি প্রশ্ন করি:
-কোথায় যাব মামা।
মামা ধমকে বললেন:
-আয়। প্রশ্ন করবি না। সন্ধ্যার পর আমি কথার উত্তর দিই না। যা জানার জানতে হবে দিনের আলোতে। এখন শুধু দেখতে থাক।
রিকসা চলতে শুরু করল। কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা নীলক্ষেত বস্তিতে থামল। মামা রিকসা থেকে নামলেন না। একজন দৌড়ে এসে পলিথিন-ভরা তরল হাতে দিল। মামা দাঁত দিয়ে পলিথিন ছিদ্র করে বেড়ালের মতো চুকচুক করে পুরোটা তরল গলায় ঢেলে দিয়ে বললেন:
-আজকের হিসাব কি?
লোকটি উত্তর দিল:
-ভালাই মামা। কালকে পৌঁছাইয়া দিমু।
শফি মামা তন্ময় কণ্ঠে বললেন:
-আচ্ছা।
লোকটি অতীব বিনয়ের সঙ্গে জানালো:
-আরও মাল লাগবো মামা।
একই রকমের তন্ময়তায় মামা বললেন:
-আচ্ছা।
কথা শেষে মামা ইশারা করলেন। রিকসা চলতে শুরু করলো। এবার মেডিকেল পেরিয়ে নিমতলীর কাছে। একই ঘটনা এখানেও ঘটল। চাঁনখারপুল। পলাশীর মোড়। জেলখানার গেট। শাহবাগের কোণ। সব জায়গাতেই মামা একটা করে পলিথিন মারছেন আর হিসাব-পত্র নিচ্ছেন। মামা কি মামা না রাতের বাদশাহ! আমার কথা কি টের পেলেন? জনান্তিকে বলে উঠলেন:
-আমি কিছু না। নিমিত্তি মাত্র। আমার মত ম্যালা মামা ঢাকা শহরে। মামারা সবাই ঘোরে অন্ধ। তাদের জগত বন্ধ। দরজা নাই। জানালা নাই। আমি কিছু না। নিমিত্তি মাত্র।
আমি উৎকর্ণ হয়ে মামার কথা শুনছি। গূঢ় রহস্যময় তত্ত্বকথা। চর্যাপদের কবিদের মতো আলো-অন্ধকারময় সান্ধ্যভাষায় কথা বললেন তিনি। প্রতীকের ভেতর দিয়ে ভাব প্রকাশ করছেন। রিকসা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, আবার সেখানে চলে এসেছে। তিনি ধীর ভাবে নামলেন। আমাকে নিয়ে নিস্তব্ধ রমনার কালো শরীরে প্রবেশ করলেন। পথ-ঘাট সব তার মুখস্ত। খানা-খন্দ পেরিয়ে ভবঘুরেদের বস্তিঘরগুলোর পাশে দাঁড়ালেন। হাল্কা কাশির মতো শব্দ করে মামা বললেন:
-ফুলি! ও ফুলি!
সঙ্গে সঙ্গেই ফুলির উত্তর পাওয়া গেল:
-কও মামা।
একটা চ্যালা ঘরের বাঁশের বেড়া খুলে ফুলি উঁকি দিল। অবাক হয়ে সে আরও বললো:
-ও খোদা! ওই সাম্বাদিক ব্যাডাও দেহি তোমার লগে জুটছে!
মামা ফুলিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন:
-সাম্বাদিক না রে। আমি সাম্বাদিক চিনি। গোয়েন্দা-পুলিশও না। হেগোর আমার কাছে কাম নাই। এই বান্দা বিবাগী। বড়ই বিবাগী রে। কি আছে, আমাগো খাইতে দে।
ফুলি এক জগ পানি এগিয়ে দিয়ে খাবার বাড়তে লেগে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে মামা আর আমি চালাঘরের মেঝেতে বসেছি। শত ছিন্ন একটি শীতল পাটিতে আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে কম পাওয়ারের একটি লাইটের নিভু নিভু আলো। রমনার দানবীয় অন্ধকারের মধ্যে এই সামান্য আলো ভৌতিক ছাপ ফেলেছে।
ফুলি তিনটি মেলামাইলের প্লেট বিছিয়ে দিল। সে-ও এতোক্ষণ না খেয়ে আছে। খাবার দেখে আমার চোখে জল চলে এলো। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করার পর এই কিশোরীর সামনে একদলা ভাত, একটি সবজির ঘণ্ট, সামান্য ডাল। মামা মনে হয় কিছু বুঝতে পেরেছেন। তিনি উদাস কণ্ঠে বললেন:
-খাও মিয়া খাও। আল্লাহ তালার রিজিক। যার জন্য যেমন ব্যবস্থা। খাও খাও।
আচ্ছন্নের মতো খেতে লাগলাম। আমারও কম পরিশ্রম আর হাঁটাহাটি হয় নি! খিদের পেটে গো-গ্রাসে খাচ্ছি আর দেখছি, কি পরম মমতায় ফুলি ভাত খাচ্ছে। পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী এই মুর্হূতে আর কেউ নেই। আমাদের খাওয়াতে খাওয়াতে এবং নিজে খেতে খেতে ফুলি কি হঠাৎ বদলে গেল? সে এখন সাধারণ সদ্য যুবতী মাত্র নয়। আবছা আলোর প্রক্ষেপে মাতৃসম প্রতীমায় ফুলি যেন সন্তানদের অন্নদান করছে।
কথা বলে উঠলেন মামা:
-আমি কি তোমারে এতোবেলা কুনু কথা কইছি?
আমি উত্তর দিলাম:
-জ্বি না মামা।
শফি মামা কথা থামালেন না। বললেন:
-সন্ধ্যার পর আমি কথার উত্তর দিই না। যা জানার জানতে হবে দিনের আলোতে। এখন শুধু দেখতে থাক। রাত দেখার দিন কথার। ঠিক কি না?
আমি সায় দিলাম:
-জ্বি মামা, ঠিক।
মামা কি যেন ভেবে আমাকে বললেন:
-এখন তোমারে একটা কথা বলি? কি কও মিয়া?
আমি আগ্রহে মাথা নেড়ে বলি:
-জ্বি মামা বলেন।
শফি মামা দার্শনিকের মতো বললেন:
-ইতর বন্ধুর চেয়ে মানী শত্রু ভালা। বুঝছ মিয়া।
আমি তর্কে গেলাম না। প্রশ্নও করা ঠিক মনে করলাম না। তিনি যা বলার নিজের ইচ্ছাতেই বলবেন। আমি সংক্ষেপে বলি:
-জ্বি মামা, বুঝেছি।
মামা হাসলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন:
-দুর মিয়া কিছুই বুঝ নাই।
আমি অবাক বিস্ময়ে মামার দিকে তাকিয়ে আছি। মামা এখনও হাসছেন। প্রসঙ্গ বদলে তিনি বললেন:
-তোমার এখন ঘুম পাইছে। তুমি কিছুই বুঝবা না। পরে বুঝবা মর্মকথা। ...ফুলি...ফুলিরে...
হাড়ি-পাতিল ঠিকঠাক করতে করতে ফুলি উত্তর দেয়:
-কন মামা।
মামা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
-তুই তোর খালার ঘরে যা গিয়া। মেহমান আইজ আমার সাথেই থাকবো। ওর বাসায় যাওয়ার অবস্থা নাই।
আমি ঢুলুঢুল চোখে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুটে শুনতে পেলাম মামা ফুলিকে বলছেন:
-জানস ফুলি, বড়ই আফসোস!
ফুলির অবাক কণ্ঠ শোনা যায়। সে জিজ্ঞেস করে:
-কি হইছে মামা?
মামা গভীর মমতায় বললেন:
-এই বিবাগী মেহমানের বন্ধু হইল খবিস এনামুল। বড়ই আফসোস!
ফলির বিস্ময় আরও বাড়ে। সে বিড়বিড় করে বলে:
-কও কি মামা!
ফুলি যেন কোনও দিন আমাকে চোখে দেখে নি। চোখ ছানাবড়া করে আমাকে দেখতে দেখতে সে বলল:
-আশ্চার্য!
ফুলির দিকে তাকানো অবস্থাতেই আমার দু’ চোখ মুদে এলো। বহুদিন পর আবার মায়ের মুখ ভাবতে ভাবতে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭
জেডএম/