ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিপ্লব ও সংহতি দিবস

সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক

মোহাম্মদ এমরান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২৪
সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়ে দেশবাসী।

পরে মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তদের সঙ্গে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন।

সেসময় মেজর জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন মুজিব হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন মেজর। এমনকি খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় থাকলেও ক্ষমতাশালী ছিলেন মুজিব হত্যায় জড়িতরা।  

এর তিন মাস পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয় অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ ও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা। নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের পর খালেদ মোশাররফ সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।  

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান
৩ নভেম্বর দুটি ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেওয়া হয়। একটি অভ্যুত্থান, অন্যটি ঢাকা কারাগারে হত্যাকাণ্ড (জেল হত্যা)। এ দুটি ঘটনার পর মধ্যরাতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পৃথক অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়। খালেদ মোশারফ ক্ষমতা হাতে নিলেও সরকার গঠন করতে পারেননি। সরকারহীন ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটে দেশের কয়েকটি দিন। এর ফলে ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। যার পুরোভাগে ছিল সেনাবাহিনী। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান আর ঘাত-প্রতিঘাতে দেশে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। সেই অভ্যুত্থানে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দেশে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে তার। এর দুই-তিন দিনের মধ্যে জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। স্বস্তি ফিরে আসে দিশেহারা জাতির মধ্যে।

৭ নভেম্বর দেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়ার একটি দিন। নভেম্বর মাসের শুরুতে যে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল; অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে যে চরম শঙ্কায় পড়ে দেশ; কী হবে যে অজানা আতঙ্ক জনমনে বিরাজ করে; তার অবসান হয়েছিল ৭ নভেম্বর।  

জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল। জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসীম সাহসের স্বাক্ষর রাখেন। মূলত এসব কারণে জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল। এ আস্থাই ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার দিকে নিয়ে আসে।

১৯৭৫ সালের ৯ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করা হয়। তিনি এক চক্রান্তের শিকার হইয়া আটক হন। কিন্তু বাংলার দেশপ্রেমিক বীর সিপাহীরা গত শুক্রবার প্রভাতে সমস্ত চক্রান্তের অবসান ঘটাইয়া তাহাদের প্রিয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন এবং তাহাকে স্বীয় পদে বহাল করেন। ’

দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্নের প্রহর শেষ হয়েছে। মেজর জেনালের জিয়াউর রহমান সাময়িকভাবে বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ’ প্রতিবেদনে ৭ নভেম্বরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের বর্ণনা উঠে আসে- ‘এত আনন্দ, এত উল্লাস- সিপাহী ও জনতার হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের কোরাস, স্লোগানের মাঝে কামানের এমন অর্কেস্ট্রা- এ এক অজানা ইতিহাস। ’

নতুন দল গঠন
রাষ্ট্র ক্ষমতায় গণমানুষের অংশীদারিত্ব ও গণতন্ত্রায়নের জন্য ১৯৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় জাগদল। যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়াউর রহমান। দলটি রাজনীতিতে সাড়া ফেলতে না পারায় জাগদল জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে রূপ নেয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাতার লক্ষ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের রূপরেখা দেন। ‘৭৮ সালের ১ মে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে নতুন দলের জন্ম হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির শিখরে নিয়ে যান। বিশ্ব দরবারে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তার দল বিএনপি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনা সদস্যের গুলিতে শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

বিএনপির স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন
২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। দেশের এই প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী রাষ্ট্র-ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দুই ছেলেকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সংস্কারের নামে একটি অংশ খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার ছক কষে। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তা রুখে দেন। ব্যর্থ হয় সংস্কারপন্থীরা। প্রায় ১৮ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ বিনা ভোটে সাড়ে ১৫ বছর রাষ্টীয় ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। এই দীর্ঘ সময় বিএনপির ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মামলা-হামলা, হয়রানি, গ্রেপ্তার, গুম-খুন, বাড়িঘর ছাড়া করে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল।  

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চরম স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতন ঘটে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘদিনের দুঃস্বপ্ন ভেদ করে এখন খোলা আকাশে মুক্তমনে রাজনীতি করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

লেখক: চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির নেতা

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।