সন্ত্রাস! নামটা শুনলেই যেন চোখে ভেসে ওঠে ভয়ংকর দৃশ্য-কিছুটা সিনেমার মতো, যেখানে একদল অশিক্ষিত, তামাক চিবানো লোক রাস্তায় হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করে। তবে বাস্তবে এই সন্ত্রাসী বন্ধুরা তো আর সিনেমার চরিত্র নয়।
এই পুরো পরিস্থিতি যেন এক অদ্ভুত কমেডি স্ক্রিপ্টের মতো, যেখানে টাকার জন্য মানুষ নিরাপত্তা হারাচ্ছে, কিন্তু সবাই জানে যে, সন্ত্রাসীদের থামানো প্রায় অসম্ভব! আর সেদিকে তাকিয়েও মনে প্রশ্ন জাগে, ‘কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এত কিছুর পরেও সন্ত্রাসীদের থামাতে পারছে না?’
সন্ত্রাস একটি রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রধান শত্রু। এটি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে না, বরং দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও ব্যাহত করে। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসের বহুমুখী রূপ দেখা যাচ্ছে—ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর উপস্থিতি সত্ত্বেও কেন সন্ত্রাসীরা শক্তি প্রদর্শন করতে পারছে, সে প্রশ্ন আজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সন্ত্রাসীরা কি সরকারের চেয়ে ক্ষমতাধর? এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে রাষ্ট্রের চেয়ে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শক্তিশালী হতে পারে না। কিন্তু যদি তারা আইনের শাসনকে অমান্য করে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে জনগণের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, তবে তা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নির্দেশ করে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এজন্য রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে সক্ষম।
সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো দলেরই হয় না। তারা শুধু স্বার্থের জন্য এক দলের ছায়ায় অবস্থান নেয় এবং পরিস্থিতি বদলালে অন্য পক্ষের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। ফলে সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক রং বিবেচনা না করে, শুধু অপরাধী হিসেবেই বিচার করা উচিত। দলীয় পরিচয়ে অপরাধীদের রক্ষা করা হলে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতে তাদের দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারের সময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কম-বেশি হয়েছে। বিগত সরকারের সময় দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ব্যাপক আকারে সংঘটিত হয়েছে। দলীয়ভাবে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পরিচালিত হয়েছে এবং কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। ৫ আগস্টের পরও যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না কমে থাকে, তবে বোঝা যায় যে, কেবল সরকার পরিবর্তন করলেই সন্ত্রাস বন্ধ হয় না। বরং, এটি দমনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শক্তিশালী আইনি কাঠামো দরকার।
বর্তমানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো অপরাধ সাধারণ জনগণের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে- ১. অর্থনৈতিক সংকট: জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে অনেকেই অপরাধের পথে যাচ্ছে। ২. আইনের শিথিল প্রয়োগ: অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা হলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ৩. পুলিশি কার্যক্রমের দুর্বলতা: সন্ত্রাসীরা যদি আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায়, তবে তারা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ৪. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা: কিছু অপরাধী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপরাধ চালিয়ে যেতে সাহস পায়, কারণ তারা জানে যে, রাজনৈতিক প্রভাব বা ক্ষমতার আড়ালে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
এমনকি কিছু রাজনৈতিক নেতা বা দল তাদের অপরাধকে সহানুভূতির চোখে দেখেন, যদি সেটা তাদের রাজনৈতিক লাভের সাথে সম্পর্কিত হয়। অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়, কারণ তারা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিভিন্ন ধরনের হুমকি বা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
এছাড়া, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অপরাধীরা জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষ জানে যে, এই অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে না এবং তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দণ্ড প্রদান করা হবে না। এ ধরনের পরিস্থিতি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা এবং আইনের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে। রাজনৈতিক দলের কিছু সদস্য যখন অপরাধীদের আশ্রয় দেয়, তখন তারা আইন ও সমাজের প্রতি আস্থা হ্রাস পায় এবং অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। এই অবস্থা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকলে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ে এবং দেশের বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
মানুষ এখন চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সাধারণ জনগণের প্রধান চাহিদা নিরাপত্তা। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী—সবাই আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাতে বাইরে চলাফেরা করা অনেকের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।
সন্ত্রাসীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে অন্যরা একই পথ অনুসরণ করতে ভয় পায়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কারও রাজনৈতিক পরিচয়, সামাজিক অবস্থান বা অর্থের জোর যেন বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সন্ত্রাসীরা কীভাবে শক্তি প্রদর্শন করছে? যৌথ বাহিনী এবং সেনাবাহিনী মাঠে থাকার পরও কেন সন্ত্রাসীরা দাপট দেখাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে- ১. অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের যোগসাজশ। ২. সন্ত্রাসীরা গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যা সহজে ধরা যাচ্ছে না। ৩. নিরাপত্তা বাহিনী শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় নজরদারি করছে, কিন্তু অপরাধীরা এলাকা পরিবর্তন করে অপরাধ চালাচ্ছে। সেনাবাহিনী ও যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম আরও কঠোর ও বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি অপরাধীকে ধরতে গোয়েন্দা তথ্যের যথাযথ ব্যবহার জরুরি।
ড. ইউনূস কি পারবেন সন্ত্রাসবাদ দূর করতে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত, একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি। তার কাজ মূলত দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত। যদিও তিনি সমাজের জন্য অসাধারণ কাজ করেছেন, সন্ত্রাসবাদ দূর করার মতো একটি জটিল এবং বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় তার একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট হবে না। সন্ত্রাসবাদ একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এজন্য শুধু একজন ব্যক্তি, এমনকি একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরও একক প্রচেষ্টা সন্ত্রাসবাদ দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে হলে রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্রীয় শক্তি, কঠোর আইন, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের মূল চাবিকাঠি। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন বা কার্যক্রম মোকাবিলায় শুধু ইচ্ছাশক্তি নয়, একটি শক্তিশালী কাঠামো, সুসংহত আইন ও অপরাধ দমনকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য। সন্ত্রাসবাদ কমানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সমস্ত রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যদি ড. ইউনূসকে সন্ত্রাস দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে তাকে অবশ্যই এই দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি সুরক্ষিত ও শক্তিশালী কাঠামো দিতে হবে, যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকতে হবে। তিনি যেমন দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছেন, তেমনই সন্ত্রাস দমনেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এখনই প্রয়োজন- ১. আইনের কঠোর প্রয়োগ: অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। ২. পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করা। ৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মানুষকে অপরাধমুক্ত জীবনের সুযোগ দেওয়া। ৪. রাজনৈতিক সদিচ্ছা: অপরাধীদের দলীয় পরিচয় ভুলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকৃত পরীক্ষা তখনই হয়, যখন কোনো সরকার অপরাধীদের শুধুমাত্র দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, বরং তাদের অপরাধের প্রকৃত মাত্রা অনুযায়ী কঠোরতম শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় ক্ষমতাসীন দল অপরাধীদের রক্ষা করতে নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে। অনেক দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে দুর্নীতিবাজ, খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী—যেই হোক না কেন, যদি সে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে, তবে তার জন্য আদালতের রায়ও পাল্টে দেওয়া হয়। এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পর্যন্ত দেওয়া হয়, যেন তারা অপরাধ করার জন্য আরও উৎসাহিত হয়।
একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অপরাধীকে দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে আইনের আওতায় আনার কথা বলা হলেও, বাস্তবে দেখা যায়, অপরাধী যদি ক্ষমতার খুব কাছের কেউ হয়, তাহলে তার বিচার তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগও গ্রহণ করা হয় না। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও কখনো কখনো প্রভাবিত করা হয়, যাতে অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায়। এভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই অনেক দেশে ন্যায়বিচারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, যেখানে অপরাধীর দলীয় পরিচয়ই তার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়, এবং সাধারণ জনগণ চিরকাল বিচারহীনতার শিকার হয়।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রের চেয়ে কোনো অপরাধী শক্তিশালী হতে পারে না, আর জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে। যে কোনো মূল্যে দেশের মানুষের আতঙ্ক দূর করতে হবে এবং একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৫
এসএএইচ