ঢাকা: ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’-গানটির গীতিকার ও সুরকার আলাউদ্দিন আলী। কণ্ঠ দিয়েছেন মিতালী মুখার্জি।
এই দুনিয়া আর ডিজিটাল দুনিয়ার পার্থক্যও আকাশপাতাল। গোটা বিশ্বের মানুষই এখন মাটির দুনিয়ার চেয়ে ডিজিটাল দুনিয়াকেই বেশি ভালোবাসে। মাটির দুনিয়াতে খায়, ঘুমায়, পয়োনিষ্কাশন করে। আর ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজের ইচ্ছামতো সময় কাটায়। যা মন চায় তা-ই করে। যাকে ইচ্ছা ভালোবাসে। যাকে ইচ্ছা গালাগাল করে। রাজা-বাদশাহ, ভিখারি, ফকির-দরবেশ, চোর-বাটপার, জ্ঞানী-মূর্খ সবাইকেই মাটির দুুনিয়া ধারণ করে। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করে। কখনো কখনো অতি মূল্যায়নও হয়, সেটা অবশ্য সৃষ্টিরই রহস্য। আর ডিজিটাল দুনিয়ায় আমাদের দেশের বাসিন্দারা পুরোটাই আউলা ঝাউলা। এখানে যে যত বেশি গালাগাল করতে পারে, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলতে পারে, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা সত্যের মতো করে প্রচার করতে পারে, যে যত বেশি নির্লজ্জ হতে পারে, তার তত বেশি ভিউ, তত ক্লিক। সে তত বেশি সেলেব্রিটি। আগামী নির্বাচনে এই ডিজিটাল দুনিয়ার সেলেব্রিটিরা কত মানুষের ঘুম যে হারাম করে দেবে, কত মানুষকে যে পাবনার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার উপক্রম করবে, তা এখনই অনুমান করা যায়। সবাই সবার জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন হেফাজত করেন।
বিল গেটস ও পল অ্যালেন আলটেয়ার পৃথিবীতে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটান। ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল বেসিক ইন্টারপ্রেটার নির্মাণ ও বিক্রির জন্য মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর শুরু হয় নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করছে। আর পৃথিবীর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানি মেটা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টুইটার, এক্স হ্যান্ডেল ডিজিটাল দুনিয়ায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মেটার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আরও একটি প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম, সেটা হলো গুগল। এ কোম্পানির প্রোডাক্ট হলো ইউটিউব। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিতে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ এআই। তথ্যপ্রযুক্তির এসব প্ল্যাটফর্মের সর্বোত্তম ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনে দুনিয়াব্যাপী তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে; যার ফলে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। বদলে যাওয়ার বাতাসে আমরাও উন্মত্ত। উন্নত বিশ্বের মানুষ ডিজিটাল দুনিয়ার সুফল কাজে লাগিয়ে জ্ঞানার্জন করছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। আমাদের দেশের ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশ করলে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা হয়। যে যার মতো বয়ান দিচ্ছে। সত্য আড়াল করে মিথ্যা উগরে দিচ্ছে। রাজনীতি, পরনিন্দা, পরকীয়া, নগ্নতা, উগ্রতা, যৌন সমস্যা, কোরআন-হাদিসের ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করাসহ এমন কোনো বিষয় নেই, যা ডিজিটাল দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। যতটা না ভালো কাজে, ভালো পথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে অপব্যবহার। দেশে জুলাই বিপ্লবের মতো বিশাল একটি ঘটনা ঘটে গেল। এই বিপ্লবে ডিজিটাল দুনিয়ার বড় ভূমিকা আছে- এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনেক নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, অনেক নারী উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী হয়েছেন; এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন সামাজিক অপরাধের জন্মও হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমের অপব্যবহারে। জুলাই বিপ্লবের অর্জন ধ্বংস করতে এখন দ্বিগুণ উদ্যমে ডিজিটাল দুনিয়ার অপব্যবহার হচ্ছে।
সুরকার জুলাই বিপ্লবের পর দেশে এখন শুরু হয়েছে আরও একটি নতুন বিভাজন। এক পক্ষের দাবি হলো- ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। অন্য পক্ষের দাবি- আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন তাড়াতাড়ি হবে নাকি বিলম্বিত হবে সে বিষয়ে রাজনীতিবিদ, সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান আলোচনা চলছে। এ আলোচনার মধ্যেই কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আলজাজিরার সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান ‘টক টু আলজাজিরা’য় নতুন করে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। গত রবিবার ‘মুহাম্মদ ইউনূস : রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এ সাক্ষাৎকার আল জাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো তাদের জন্য ভালো সমাধান। দেশের জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে চলে যেতে বলছে না। আমরা এমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি যেখানে লোকেরা বলছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দায়িত্ব হস্তান্তর কর। ’ প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পর নির্বাচন নিয়ে বিভাজন আরও বেশি স্পষ্ট হচ্ছে। এ বিভাজন নিয়ে চলছে বাগ্যুদ্ধ। সেই সঙ্গে চলছে ডিজিটাল যুদ্ধ। শুধু যুদ্ধ নয়, ডিজিটাল দুনিয়ায় যে যাকে যেভাবে পারছে অপমান-অপদস্থ করছে। যত দিন যাবে ডিজিটাল দুনিয়ার যুদ্ধ তত বেশি জোরদার হবে। আগামী নির্বাচনের প্রচার-অপপ্রচারও হবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। নির্বাচনের সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে কে কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এখন প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সবার হাতেই অ্যানড্রয়েড বা আইফোন। বাটন ফোন নেই বললেই চলে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রায় সবাই এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে গেছেন। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে বা কেউ কোনো কথা বললে মুহূর্তেই তা চলে যায় ডিজিটাল দুনিয়ায়। সেটা কেন্দ্র করে লাইক, কমেন্টের প্রতিযোগিতা। কে কার আগে কমেন্ট করতে পারে, কে কার চেয়ে ভালো কমেন্ট করবে, কে কার চেয়ে খারাপ ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানাবে, কে কার চেয়ে জ্ঞানী, কে ধার্মিক, কে বকধার্মিক, কে নাস্তিক, কোনটা হালাল, কোনটা হারাম, কার ইমান আছে, কার ইমান নাই ইত্যাদি কতভাবে যে প্রতিক্রিয়া জানায় তা ভাবা যায় না। ডিজিটাল দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যা তথ্য প্রচার। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টুইটার, টিকটক, এক্স হ্যান্ডেল, ইউটিউবের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এসব মিথ্যা অপপ্রচারের ব্যাপারে কেউ যদি প্রকৃত তথ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করে তাহলে মিথ্যার সিন্ডিকেট একযোগে আক্রমণ করে। সে কারণে সংঘবদ্ধ মিথ্যাচারে চাপা পড়ে যাচ্ছে সত্য ও প্রকৃত তথ্য।
অস্থির একসময়ে আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে ডিজিটাল দুনিয়ায় কী ঘটবে, তা এখন ভাবলেই মাথা চক্কর দেয়। সুতরাং এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে মিথ্যা, প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করার জন্য নিজস্ব দক্ষ ডিজিটাল টিম গড়ে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে তথ্যভান্ডার। সেই সঙ্গে যারা মিথ্যা বলছে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, এক পক্ষের বিরুদ্ধে আরেক পক্ষকে উসকে দিচ্ছে, ভুয়া আইডি ব্যবহার করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কারণ একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে অনেক মানুষের শ্রম ও মেধা-মননের প্রয়োজন হয়। আর একটি সমাজ নষ্ট করার জন্য দু-একজন নষ্ট মানুষই যথেষ্ট। প্রত্যেকে যার যার বাসার দিকে লক্ষ করলে দেখব, বাসায় যদি তিনটি শোবার ঘর থাকে, দুটিতে হয়তো অ্যাটাচড বাথরুম থাকে, একটিতে কমন বাথরুম থাকে। কোনো কোনো বাসায় হয়তো বসবাসের রুমের তুলনায় বাথরুমের সংখ্যা কমও হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে ১০-১৫ জন মানুষ সম্মিলিতভাবে হয়তো একটি টয়লেট ব্যবহার করে। বসবাসের রুমের তুলনায় বাথরুম বা টয়লেটের আকার সাধারণত ছোট হয়। নির্দিষ্ট প্রয়োজন ছাড়া বাথরুম বা টয়লেটের ব্যবহার শোবার রুম বা অন্যান্য রুমের তুলনায় সংখ্যায় কম হয়। শোবার রুমের দরজা অধিকাংশ সময়ই খোলা থাকে। কিন্তু বাথরুম বা টয়লেটের আয়তন ছোট হলেও দরজা সব সময়ই বন্ধ রাখা হয়। কারণ বাথরুম থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সমাজব্যবস্থাও একটি বাসার মতোই। সামাজিক শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও স্থিতি বিনষ্টের জন্য গুটিকয় নষ্ট মানুষই যথেষ্ট। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব তাদের দরজা বন্ধ করা দরকার। তা না হলে নষ্ট মানুষের পাল্লা দিনদিন ভারী হবে। নষ্ট মানুষের নষ্টামি সমাজের ভারসাম্য আরও বিনষ্ট করবে। এমনিতেই আমাদের বলা হয় ‘হুজুগে বাঙালি’। বিপ্লব যেমন আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, তেমন নষ্টভ্রষ্ট মানুষ চেনা-জানার সুযোগও তৈরি হয়েছে। এখনই সময় মিথ্যাচার ও নষ্টামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। এখনই সময় সুস্থ চিন্তা বিকশিত করার।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
এসআইএস