ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশের শিক্ষাখাত: অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভাবনায় বিএনপি

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০১, মে ১২, ২০২৫
বাংলাদেশের শিক্ষাখাত: অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভাবনায় বিএনপি অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার সিংহদ্বারে লেখা রয়েছে- “কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে।

কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি। ”

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দেড় দশক বাংলাদেশে উপরোক্ত উক্তির বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেছে। শেখ হাসিনার আমলে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তার ক্ষত সারাতে আগামী কতো যুগ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। কেননা তার আমলেই এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা আজগুবি এক্সপেরিমেন্টের ভেতর দিয়ে গেছে। নতুন কারিকুলাম, পরীক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও অবাধে নকলের সুযোগ, শ্রেণি কাঠামোগত পরিবর্তনের পরীক্ষণ, নতুন ধারার প্রশ্ন পদ্ধতিসহ তিন মেয়াদে এমন সব বেসিক বিষয় নিয়ে তারা কাটাছেঁড়া করেছে যে পুরো জাতি ছিল বিভ্রান্ত। কূল-কিনারাহীন ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় কেটেছে অভিভাবকদের জীবন। এমন দিক-দিশাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিল শিক্ষাবিদরাও।  

আমার মনে হয়, কখন কি পদক্ষেপ কিংবা নির্দেশনা আসে, তা দ্রুত পালন করতে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়, তা নিয়ে শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোও সদা তটস্থ থাকতো।  

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই দেশের শিক্ষাখাতে নজর দেন। কেননা তিনি জানতেন, ব্রিটিশ কলোনিয়াল ব্যবস্থায় এদেশের মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। পাকিস্তানী শাসনামলেও এদেশের মানুষের শিক্ষার পরিবেশ সেভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের সময়ও শিক্ষাখাতকে একটি সুস্পষ্ট গাইড লাইন দেওয়া যায়নি। ফলে তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এদেশের শিক্ষাখাতের উন্নয়ন। কেননা তিনি জানতেন, মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য,সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হচ্ছে প্রধান নিয়ামক। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ লাভ করে।  

১৯৭৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর শহীদ জিয়া ঢাকায় একটি “জাতীয় শিক্ষা কর্মশালা” আয়োজন করেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সারাদেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষাকর্মী এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। শহীদ জিয়া এই ওয়ার্কশপে বারো ঘণ্টাব্যাপী শিক্ষাকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের শিক্ষা বিষয়ক মতামত ধৈর্যের সাথে শোনেন এবং পরে প্রদত্ত গ্রহণযোগ্য মতামতের ভিত্তিতে তিনি নিজে একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। ওই বক্তব্যে তাঁর শিক্ষা চিন্তা ও দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে।  

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে একটি জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘অন্তর্বর্তী শিক্ষানীতি সুপারিশ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যাতে জনগণ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। এ রিপোর্টে বৃত্তিমূলক, কারিগরি, কৃষি ও চিকিৎসার সম্প্রসারণে বিশেষ জোর দেয়া হয়। তিনি নিজেও মনে করতেন যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য বৃত্তিমূলক কৃষি ও বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ একান্ত প্রয়োজন। শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র’ প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২১ নং ধারায় বাংলাদেশে একটি ‘গণমুখী ও জীবননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম’ চালুর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়েছিল বিএনপি সরকার “এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী যা জাতীয় ঐক্য আনে, উৎপাদন বাড়ায় এবং ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়। ” শিক্ষিত যুবসমাজ যেন বেকারত্বের অভিশাপে নিপতিত না হয়—সেজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক, কারিগরি ও বৃত্তি মূল শিক্ষার দ্রুত প্রসারে সরকারের সদিচ্ছার কথা ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কারিগরি শিক্ষাকে অভিহিত করতেন জনকল্যাণের শিক্ষা হিসেবে। তার দর্শনের মধ্যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও ভাষাগত উৎকর্ষের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি প্রায়ই বক্তব্য রাখতেন। এমনকি বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২৭ ও ২৮ নং ধারায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। তিনি বাংলায় মাধ্যমিক ও উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনায় জিয়া সংশ্লিষ্টদের দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিটি শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করতে তাঁর সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। জিয়া সরকারের সময় গৃহীত অন্তবর্তীকালীন দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতের উন্নয়নে অগ্রাধিকারসহ বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়।
শিক্ষাখাতে শহীদ জিয়ার এই অবিস্মরণীয় কর্মযজ্ঞ ফের শুরু করেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে শিক্ষাখাতে আমূল পরিবর্তন আসে। দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিশেষ নজর দেওয়া হয় নারী শিক্ষাখাতে।  

নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এবং পরিবারগুলোকে তাদের মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর জন্য আগ্রহী করতে ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয় এবং ছাত্রীদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়। সে বছর সরকার চারটি প্রকল্প হাতে নেয়। সেগুলো হলো মহিলা মাধ্যমিক স্কুল সহায়তা প্রকল্প ২, মহিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রকল্প, মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন প্রকল্প ও মহিলা মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি প্রকল্প।  

এছাড়া ১৯৯৩ সাল থেকে বেগম জিয়ার সরকার শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করে, যা ১৯৯৬ সাল নাগাদ ধীরে ধীরে ১২৫৫টি ইউনিয়নে সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় পুরো দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া যখন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন দেশের স্কুলগুলোতে ছাত্র ও ছাত্রীদের অনুপাত ছিল ৫৫:৪৫, তিনি যখন ১৯৯৬ সালে মেয়াদ শেষ করেন তখন এই অনুপাত দাঁড়ায় ৫২:৪৮। এছাড়া ১৯৯০ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর তালিকাভুক্তির সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০ লক্ষ, যার মধ্যে প্রায় ৫৪ লক্ষ ছিল ছাত্রী। ১৯৯৬ সালে মোট তালিকাভুক্তি বেড়ে হয় ১৭৬ লক্ষের মত যার মধ্যে প্রায় ৮৪ লক্ষ ছিল ছাত্রী। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের তালিকাভুক্তি বাড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ।

১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস খালেদা জিয়ার উদ্যোগ সম্পর্কে লিখেছিল, “Now as Prime Minister, Mrs. Zia -- in contrast with Benazir Bhutto when she first became Prime Minister of Pakistan -- is aggressively promoting education and vocational specially of girls.”
শিক্ষা নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কর্মযজ্ঞের পরম্পরা দেখা যায় তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফার মধ্যেও। রাষ্ট্র সংস্কারের এই ধারাগুলোর মধ্যেই একটি দেশ ও জাতির কল্যাণে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।  

এর ২৪ নম্বর ধারায় শিক্ষা বিষয়ে বলা হয়েছে, “বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা-ভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। একই মানের শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।  

যোগ্য, দক্ষ ও মানবিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সকল খাতকে ঢেলে সাজানো হবে। শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতে গবেষণা ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ক্রীড়া উন্নয়ন ও জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনৈতিক আকাশ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা হবে।

চব্বিশের গণবিপ্লব এদেশ থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে উন্মোচন করেছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। এই সম্ভাবনা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্প-সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার এখনই সময়। পুরো জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হলে আমাদের ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে আগে ঠিক করতে হবে। সেক্ষেত্রে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেখা পথে তারেক রহমান অনুসৃত ৩১ দফাই হতে পারে মূল নিয়ামক। আগামীতে দেশ গঠনের সুযোগ পেলে শিক্ষাখাতে সেই পথেই হাঁটবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।  

লেখক: গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।