ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

উন্নয়নের আড়ালে কালো অর্থনীতির উদ্ভব

আব্দুল বায়েস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:১৮, জুলাই ২২, ২০২৫
উন্নয়নের আড়ালে কালো অর্থনীতির উদ্ভব আব্দুল বায়েস

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের উন্নয়নকে বলা হতো উন্নয়ন ধাঁধা বা ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স। বিগত দশকগুলোতে চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন না হয়ে থাকলেও যতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা চোখে ধাঁধা লাগানোর মতোই বলা যেতে পারে।

কার কাছে? নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যারা, জেনে বা না জেনে, বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত ছিল; তারা ভাবতেও পারেনি যে কোনো এক সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পৃথিবীতে ‘খবর’ হয়ে উঠবে, সাড়া জাগাবে। কোনো দ্বিধাগ্রস্ত না হয়েই একসময় বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা।

দুই
বাংলাদেশের উন্নয়নকে তুলনামূলক হিসাবে ন্যস্ত করা যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে। বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা হয়, সেই পাকিস্তানের তুলনায়  বাংলাদেশ ভালো, না খারাপ আছে? এমনকি প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতের চেয়ে? পরিসংখ্যান দিয়ে পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই পাকিস্তানের মাথাপিছু জিএনআইয়ের ৫৫ শতাংশ ছিল, অথচ ২০১০ দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ছিল ভারতের ৮৭ শতাংশ, পার্থক্যটা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ দশকে দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ, কিন্তু ২০১০ দশকের শেষ দিকে হ্রাস পেয়ে হয় ৮২ শতাংশ।

তিন
সব আশাব্যঞ্জক গল্পের একটা অন্ধকার দিক থাকে। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রাকে তেমনি এক আলো-আঁধারির খেলা বললে বোধ করি ভুল হবে না। একদিকে উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, অথচ  অন্যদিকে ধনী-গরিব বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।  অর্থনীতিবিদ হারসম্যান ও রথচাইল্ড বলেছেন, টানেল প্রভাবের কথা : বিদ্যমান কাঠামোতে আয়বৈষম্যের প্রতি যদি সহনশীলতা কম থাকে, তাহলে ‘আগে বাড়া, পরে বিতরণ’ এমন তত্ত্ব বিপজ্জনক হতে পারে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান বৈষম্য সহগ (গিনি সহগ) বিপৎসীমার কাছাকাছি। বৈষম্য বেশি হলে দারিদ্র্য নিরসনে প্রবৃদ্ধির প্রভাব খাটো থাকে অর্থাৎ একই প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কম বৈষম্যের সমাজে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বেশি হবে বেশি বৈষম্যের সমাজের চেয়ে।
অন্যদিকে আশা ছিল কুজনেটসের চুইয়ে পড়া প্রভাব তত্ত্ব (বা ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট থিওরি) কাজে দেবে, কিন্তু সে আশায় যেন গুড়ে বালি। ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট  বলতে চায়, প্রবৃদ্ধির প্রারম্ভিক স্তরে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে চুইয়ে পড়া সুফলে বৈষম্য হ্রাস পায়। সেটা খুব একটা কাজ করছে বলে মনে হয় না কিংবা ভবিষ্যতে করবে এমন ইঙ্গিত আপাতত নেই বলে মনে হয়।

আর যদি ঘটেও থাকে, তা যে খুবই দুর্বল সে কথা বলা বাহুল্য। এদিকে আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তা কাম্য স্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না।

গেল চার দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধাঁধার আড়ালে-আবডালে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে কালো এক অর্থনীতির (আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি)। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ‘অর্থনৈতিক শয়তানের’ অভাবনীয় আবির্ভাব ঘটেছে। অন্ধকারে থাকা এই অর্থনীতি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রাখছে, রাজনীতিকে কলুষিত করছে, বিকৃত ভোগবাদী সমাজ সৃষ্টিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। মোটাদাগে, এটি টেকসই উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

ক্ষেত্রবিশেষে এর ভেতরে অথবা পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছে সর্বব্যাপী চরম দুর্নীতি। যদিও এ দেশে দুর্নীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, তার পরও বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির দাপুটে, ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজের। বলা যায়, সমাজের অভিভাবক এখন তাঁরাই। দুর্নীতি প্রতিবছর জিডিপির ২ শতাংশের মতো গিলে খায়। তা ছাড়া প্রতিবছর দেশ থেকে নাকি অবৈধ পথে পাচার হতো গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলার; ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নাকি ছয় হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলা হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও গেল এক বছরে দুর্নীতির মচ্ছবের সংবাদ পত্রিকার পাতায় কিংবা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত।

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা। এখন এমনকি রক্ষণশীল হিসাবেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন থেকে চার লাখ কোটি টাকা। এর একটি অংশ বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ। শেয়ারবাজার লুট করে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির ধনী মানুষের, অথচ সেই কলঙ্কিত বাজার এখনো তা-ই আছে। দিনে-দুপুরে ব্যাংক ডাকাতির কথা আপাতত না হয় থাক। তবে বলতেই হবে যে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী কিংবা ব্যাংক ডাকাতদের বেশির ভাগ দেশে অথবা বিদেশে দাপটে ও সুখে আছে। অথচ তাদের কেউ এই ১০ থেকে ২০ বছর আগেও হিমশিম খেতেন সংসার চালাতে। তাঁরা হয়ে উঠেছেন দানব। অর্থনীতির গ্রেসামস ল অনুযায়ী, মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বাজারছাড়া করে, তেমনি আজ এই সমাজে মন্দ লোক ভালো লোককে কোণঠাসা করে রাখছে। রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কালো টাকায়; এদের অস্ত্রের ভাষা কেড়ে নিয়েছে আমজনতার ভাষার অস্ত্র।

চার
দুর্নীতির কালো থাবায় সমাজটা যখন ক্ষতবিক্ষত, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেছে বলতে হয়, ঠিক তখন অন্তর্বর্তী সরকারের সরাসরি নির্দেশে চলছে অর্থপাচারের  বিরুদ্ধে অভিযানের মতো একটি মহতী পদক্ষেপ।  অভিনন্দন, ব্যাটার লেট দ্যান নেভার।

ওই অভিযানের ফলে কালো অর্থনীতির নায়কদের অভাবনীয় উত্থানের সম্যক নমুনা জাতির সামনে আজ উপস্থিত। পত্রিকার পাতা ওল্টালে অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায়। কারো কাছে শত শত কোটি টাকার এফডিআর, কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স, ১০-১২টি ফ্ল্যাট, পাচার করা অর্থ দিয়ে বিদেশে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালান্স ইত্যাদি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে এই কালো অর্থের প্রভাব অনেক। ভাতের হাঁড়ির কটা ভাত টিপলেই যেমন বোঝা যায় ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না, তেমনি চলমান অভিযানের ক্ষুদ্র নমুনা থেকে অনুমান করা যায় দেশব্যাপী অবৈধ সম্পদের পরিমাণ কত হতে পারে। শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভেতরেও আরো অনেক কর্মকাণ্ডে অবৈধ ও অনৈতিক লেনদেন হয়, যা উইপোকার মতো উন্নয়নকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর একটি কথা, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তাকে টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার তেমন হচ্ছে না বিধায় চায়ের কাপ আর ঠোঁটের মধ্যকার ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে।

পাঁচ
চলমান অভিযানের জন্য দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তবে সংশয়মুক্ত হতে পারছে না। এর কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। দুর্নীতির ও কালো অর্থনীতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত, বিশেষত অতীতে মন্ত্রী, এমপি এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারাও এ ক্ষেত্রে কম যাননি বলে অভিযোগ আছে। প্রধান উপদেষ্টার সব আন্তরিকতা সত্ত্বেও এত বড় একটি ‘সাদা বিপ্লব’ ঘটবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে, যদি তাঁর নিজের লোকেরা দুর্নীতিমুক্ত না হন।

আমরা, আমজনতা, কায়মনোবাক্যে দুর্নীতি ও কালো অর্থনীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযানের সাফল্য কামনা করি। এর প্রধান কারণ আমরা একটি ‘সাদা সমাজ’ চাই, যেখানে মেধাবী আর ভালো মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন; অর্থ, সম্পদ ও প্রতিপত্তি যেখানে প্রভু না হয়ে চাকর থাকবে। আমরা বর্তমান অবস্থার তথা অমানিশার দ্রুত অবসান চাই। আশায় আশায় তবু চেয়ে থাকি।

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার

আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিক্ষা অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য তাদের হৃদয়। ’

(কবি জীবনানন্দ দাশ)

লেখক: অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।