ঢাকা, বুধবার, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই জনবহুল এলাকায় এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনা ঘটছে

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহবুব হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৬, জুলাই ২৩, ২০২৫
সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই জনবহুল এলাকায় এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনা ঘটছে

এয়ার ফোর্সের এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনায় এত বেসামরিক মানুষের মৃত্যু দুঃখজনক বিষয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সামরিক বিমানের দুর্ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে।

কিন্তু এগুলো তেমন আলোচনায় আসে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে নেভাডার মতো কম জনবসতির এলাকায় স্পেশালাইজড এয়ার স্পেস রয়েছে। জনবহুল বসতি না থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও তা তেমন আলোচনায় আসে না। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ইনসিডেন্ট জনবহুল বসতি এলাকায়ই হয় এবং এর প্রতিক্রিয়াও ব্যাপক হয়।

অনেক রকম প্রশ্ন আসে। এয়ারক্রাফটটি ট্রেইনার, নাকি ফাইটার ছিল—এসব প্রশ্ন ওঠে। আমি নিজেই এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলাম। আমাদের কোর্সে আমরা ১২ জন ছিলাম।

এই ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনই এয়ার ক্র্যাশে জীবন হারিয়েছেন। আগে আমাদের চিফ ছিলেন আবু এসরার সাহেব। তিনিও একটা ক্রিটিক্যাল অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে আসেন। এটা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত হয়।

প্রাথমিকভাবে দুটি কারণ থেকে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমত যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হিউম্যান এররের কারণেও এটা হতে পারে। পাইলটেরও ফল্ট থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত করলে বোঝা যাবে। পাইলট কোনো ইমার্জেন্সি কল দিয়েছিল কি না তা জানা যাবে। যদি না দিয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে, পাইলটের বিবেচনায় এয়ারক্রাফটে সমস্যা ছিল না। আবার অনেক সময় পাইলট সমস্যাটি বুঝতে পারে না। আমি নিজেও তো ফ্লাই করেছি। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, ভারতে মিগ-২৯-এ প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেক পাইলট মারা গেছে, কিন্তু তা পাবলিক হতো না। মিগ-২৯ গুলো খুব পুরনো হয়ে গিয়েছিল। এটা তো একটা যন্ত্র। মেকানিক্যাল ডিভাইস। একটা গাড়ি হলে সেই গাড়িরও তো লাইফটাইম থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে নিয়মটা হলো, এয়ারক্রাফটগুলোর ফার্স্ট লাইফ শেষ হয়ে গেলে এক্সটেনশন করে চালানো হয়। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এগুলো পরীক্ষা করে দেখে লাইফ এক্সটেনশনটা দেয়। ত্রুটি নিয়ে কোনো এয়ারক্রাফটের ফ্লাই করার কথা না। ফাইটার এয়ারক্রাফটের বেলায় তো নয়ই। কারণ ফাইটার এয়ারক্রাফট এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য ফাইটার এয়ারক্রাফট কেনার ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা দরকার। প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান থাকতে হয় যে এত বছর পর এটা প্রতিস্থাপন করতে হবে। ইচ্ছা করলেই সহজে নতুন ফাইটার এয়ারক্রাফট কেনা যায় না। কারণ এর সঙ্গে জিও পলিটিকসের সম্পর্ক আছে। একটি দেশ থেকে কিনতে গেলে অন্য দেশের বাধা আসে। পলিটিকস এখানে বড় বাধা। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভালো সম্পর্ক। কিন্তু পাকিস্তানও সহজে কিনতে পারে না। প্রতিবেশী দেশ শক্তিশালী হলে অনেক দেশ কিনতে পারে না। প্রতিবেশী দেশ শক্তিশালী হলে অনেক বাধা আছে। কয়েকটি দেশ ক্লসিক এয়ারক্রাফট প্রোডিউস করে। এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলি, এভিয়েশন এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বলি—এসব বিষয়ে সায়েন্টিফিক, টেকনোলজিক্যাল মাস্টারি করতে পারে মাত্র গুটিকয়েক দেশ। ভারতের মতো দেশও এখন পর্যন্ত এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন প্রোডিউস করতে পারে না। ভারত বাইরে থেকে কিনে আনে। এ অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যেসব ফাইটার এয়ারক্রাফট কেনে, সেসব এয়ারক্রাফটের রিপ্লেসমেন্ট যদি পলিটিক্যাল কারণে ফ্রিকোয়েন্টলি না হয় তাহলে দেখা যাবে, লাইফটাইম শেষ হওয়ার পরও এক্সটেনশন দিয়ে চালাতে হয় এবং ঝুঁকি বাড়ে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, জনবহুল এলাকায় এসব এয়ারক্রাফট কেন ফ্লাই করানো হয়? আমি সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলাম। তখন আমরা বারবার বাধা দিয়েছি, উত্তরায় যেন তেমন স্থাপনা তৈরি না হয়, যাতে বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় কোনো বাড়ি করতে গেলে সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি লাগে। এ ক্ষেত্রে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে, বেশির ভাগ স্থাপনা সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি ছাড়া গড়ে উঠেছে। সিভিল এভিয়েশনের ম্যাপ আর রাজউকের ম্যাপে পার্থক্য আছে। সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি না মিললেও রাজউকের অনুমোদন মেলে। র‌্যাংগস বিল্ডিংটা ভেঙে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণের ঝুঁকি। এ ধরনের স্থাপনা আরো রয়েছে। একটি ফাইটার এয়ারক্রাফট ক্র্যাশের জন্য উত্তরায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে, একটি কমার্শিয়াল এয়ারলাইনের কোনো বিমানের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটলে ক্ষয়ক্ষতি আরো ব্যাপক হতে পারে। সিঙ্গাপুরে অনেক হাইরাইজ বিল্ডিং রয়েছে। সেখানে আইন মানা হয়। সেখানে রানওয়ের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে একতলার বেশি উচ্চতার বাড়ি নির্মাণ করা হয় না। দেশে এই সিভিক সেন্স ভাঙার ক্ষেত্রে অনেকে জড়িত। আজ হয়তো একটা এফ-৭ পড়েছে। কাল যদি একটা বোয়িং পড়ে—এই চিন্তা করা দরকার। আমি মনে করি, সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে জনবহুল এলাকা উত্তরায় যে এয়ারক্রাফটি ক্র্যাশ ল্যান্ড করেছে, এটি অনেক পুরনো এয়ারক্রাফট। এসব এয়ারক্রাফটের লাইফটাইম হয়তো বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের নতুন এয়ারক্রাফটেও এ ধরনের দুর্ঘটনা হয়েছে। ট্রেইনার এয়ারক্রাফট গ্রোব, যেটা জার্মানি থেকে এনেছি, এসবের তিনটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অনেক দেশেই হয়।

দেশে ট্রেইনার এয়ারক্রাফটগুলোর উড্ডয়নের ক্ষেত্রে জনবহুল এলাকা এড়িয়ে চলা উচিত। কিন্তু সে অবস্থা নেই। জনবহুল এলাকার বাইরে উড্ডয়নের সুযোগ থাকলে ভালো হতো। দেশে প্রতিটি বেসামরিক বাণিজ্যিক এয়ারপোর্টের সঙ্গে বিমানবাহিনী যুক্ত রয়েছে। বিমানবাহিনীর জন্য আলাদা রানওয়ে করাটাও অনেক ব্যয়বহুল বিষয়। বিমানবাহিনী আলাদা রানওয়ে চেয়ে আসছে। তবে এয়ার ডিফেন্সের কথা যদি আসে, তাহলে বেসামরিক এয়ারফিল্ডের কাছাকাছি এয়ার ফোর্সের অবস্থান থাকতে হবে। রাজধানীর কি পয়েন্টগুলোকে প্রোটেক্ট করার জন্য এটার প্রয়োজন আছে। তবে এয়ারপোর্ট জনবহুল এলাকার বাইরে থাকলে সমস্যা এড়ানো যায়। একসময় পরিকল্পনা হয়েছে আড়িয়াল বিল এলাকায় আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট করার। এখন তো মনে হয়, সেটি ভালো পরিকল্পনা ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডগুলো এয়ার ফোর্সকে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তেমনটা নেই। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, দেশের এয়ার ফোর্সের জন্য পয়সা খরচ করতে চাইলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। ভারতে তাদের এয়ার ফোর্সের জন্য আলাদা রানওয়ে রয়েছে। এটা ব্রিটিশ আমলে করা হয়েছিল। আমাদের এখানেও ব্রিটিশ আমলে বেশ কয়েকটি রানওয়ে করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এগুলো ব্যবহার করা হয়। লালমনিরহাটে, বগুড়ায়, কক্সবাজারে, বরিশালে সেই রানওয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট ব্যবহার করা হচ্ছে না। এসব রানওয়ে ট্রেইনার এয়ারক্রাফটগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ফাইটার এয়ারক্রাফটের জন্য প্রয়োজন বড় রানওয়ে। উত্তরায় বিধ্বস্ত এয়ারক্রাফটটি ছিল ফাইটার এয়ারক্রাফট। ঢাকায়ও বিমানবাহিনীর জন্য ঘাঁটি, রানওয়ে থাকতে হবে। কারণ ঢাকা আমাদের রাজধানী শহর। এই শহরের প্রোটেকশন দরকার। ৪৪ বছর আগে তেজগাঁও বিমানবন্দর ছেড়ে কমার্শিয়াল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হয় কুর্মিটোলায়। সে সময় উত্তরা সেভাবে শহর হয়ে গড়ে ওঠেনি। কাওলার জনবসতি তেমন ছিল না। তেজগাঁও বিমানবন্দর এখন বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে। সেনাবাহিনীও এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে। এটি সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামাসহ প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল চালু হয়েছে। এটির পরিবর্তনও আপাতত সম্ভব না।

আমি মনে করি, দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা এবং এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনা কমানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। টেকসই প্রোকিউরমেন্ট, মেইনটেন্যান্স ও রিপ্লেসমেন্ট পলিসি দরকার। এয়ারক্রাফট কিনতে প্রয়োজনীয় স্টাডি করতে হবে। যেকোনো জিনিসই পুরনো হলে ঝুঁকি বাড়ে। ফলে নতুন এয়ারক্রাফট কেনায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। কারণ সবার জীবনের মূল্য আছে। ঢাকার আশপাশে অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এলাকায় আরো একটা পৃথক ফাইটার বেইস প্রস্তুত করা যায় কি না সেটা সরকারের ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশই আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি কিংবা কেনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে ব্যয় বাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরনো কাঠামোতেই পড়ে রয়েছে। যুদ্ধ-প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর জায়গাটি অবহেলিত থেকে গেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যত রকম পদক্ষেপ দরকার তা নিতে হবে। জিও পলিটিকসের বাধা এড়াতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।