স্যার, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কি হবে? আমার মনে হয় হবে না স্যার। সরকারে যারা আছে তারা দৌড়ানি খাবে।
মাহতাব উদ্দিন হলেন আমার লেখার একজন পাঠক এবং আমার টকশোর দর্শক। লেখা নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবারই তিনি ফোন করেন। মতামত দেন। কোনো লেখায় কোনো শব্দচয়নে যথাশব্দ ব্যবহার না করলে তার খুব মন খারাপ হয়। তিনি খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি। ১৯৯০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংসারের টানাপোড়েনে পড়তে পারেন না। পরীক্ষার আগে পিতার মৃত্যুর কারণে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। তাই বলে পড়া বন্ধ হয়নি। টাকা জমিয়ে কিনছেন নানানরকম বই। বিয়েশাদি করেননি। স্যার, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কি হবে? আমার মনে হয় হবে না স্যার। এখন ছোট একটি ব্যবসা করেন। ওই ব্যবসার আয় দিয়ে নিজে চলেন। খুব গোপনে চারজন গরিব শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ার খরচ দেন আর শুধু বই কেনেন। বই তার নেশা। এখন তার সংগ্রহে অনেক বই। প্রতি মাসে কমপক্ষে দুটি বই কেনেন এবং পড়েন। বেশি দাম দিয়ে নতুন বই কিনতে না পারলে ফুটপাত থেকে পুরোনো বই কেনেন। দুই মাস পরপর ঢাকায় আসেন ফুটপাত থেকে বই কিনতে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ, তথ্যপ্রযুক্তি, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, কার্ল মার্কস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ অনেক বিষয়েই মাহতাব কথা বলতে পারেন। তার গানের কণ্ঠও ভালো। সুন্দর আবৃত্তিও করতে পারেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলেন, আবার সুন্দর শুদ্ধ উচ্চারণেও কথা বলতে পারেন। মাহতাবের সঙ্গে কথা বলার আনন্দ হলো-তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন আবার নিজেই তথ্যনির্ভর উত্তরও দেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকলেও তিনি একজন পড়ুয়া ও জ্ঞানী মানুষ। দেশ-দুনিয়ার খবর রাখেন। মাহতাব একজন আলোকিত মানুষ।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম-আপনার কেন মনে হলো নির্বাচন হবে না? কেন মনে হলো সরকারে যারা আছে তারা দৌড়ানি খাবে? উত্তরে মাহতাব নিজের মতো করে বলতে শুরু করলেন। বললেন, ‘স্যার, আমার ধারণাই সত্য হইব। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাইলে দেখব দেশকে সোনার বাংলা করার জন্য দুইটা লোক সুবর্ণ সুযোগ পাইছিলেন। একজন হইলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যজন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু স্বজনপ্রীতির কারণে দুইজনই ব্যর্থ হইছেন। একজন পুরোপুরি ব্যর্থ। আরেকজন ব্যর্থ হওয়ার পথে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যা বলতেন, তাই হইত। তখন তার পক্ষে সবই করা এবং করানো সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নাই। তিনি তার ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মণির পক্ষ লওয়ার কারণে ছাত্রলীগ দুই ভাগ হইছিল। সেইখান থেইক্কা ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের জন্ম হইল। তারপর তিনি কোনো কিছুই আর সামাল দিতে পারেননি। হাজার হাজার মেধাবী, শিক্ষিত তরুণ দল বাইন্দা জাসদে যোগ দিল। এক জাসদকে সামাল দিতেই শেখ মুজিব সরকার অস্থির হইয়া গেল। একই স্বজনপ্রীতির কারণে সরাইয়া দেওয়া হইল তাজউদ্দীন আহমদকে। শেখ মুজিব তার কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করলেন যে, নেতা হওয়া আর রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা এক নয়। একই রকম স্বজনপ্রীতিতে ডুইব্বা গেলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এবং দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা লইয়া তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু ছাত্রদের ঋণের বদলা দিতে গিয়া তিনি তাগো ক্ষমতার ভাগ দিলেন। সরকারের বিভিন্ন স্তরে তাগো প্রতিনিধি নিয়োগ দিলেন এবং তার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সমর্থনে ছাত্ররা তৈরি করল নতুন দল এনসিপি। জাসদ গঠন এবং এনসিপি গঠনের মইধ্যে অনেক মিল আছে। কর্মকাণ্ডেও অনেক মিল। এই দলটি গঠনের পর থেইক্কা সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। নতুন দলটির রেজিস্ট্রি রাজনৈতিক না হইলেও তারাই এখন সরকারের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতাছে। এমনকি জুলাই সনদও তাদের দাবির ফসল। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অবিশ্বাস-বিভাজন তৈরি হইছে সেটাও সরকারের স্বজনপ্রীতির কারণেই হইছে। সরকার এখন নানা চাপে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলতাছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, তাইলে বিদায় হবে বর্তমান ব্যবস্থা। সুতরাং মনে হইতেছে এখনই তারা ফিরে যাইতে চাইবে না। নির্বাচন নির্বাচন খেলা খেইল্লা শেষ পর্যন্ত কোনো এক উসিলায় হয়তো নির্বাচন না-ও দিতে পারে। ’
আপনি বলছিলেন এখন যারা ক্ষমতায় তারা নাকি দুর্নীতি করছে, এ তথ্য কীভাবে জানেন? প্রশ্নটি শুনে একটু মুচকি হেসে মাহতাব বললেন, স্যার, আমি তো আপনার কাছ থেইক্কা সবকিছু জানতে আইছি। এ কথা বলেই চায়ে লম্বা একটা চুমুক দিলেন। তারপর স্বভাবসুলভভাবে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘স্যার, দুর্নীতি বা অসৎ কাজ হইল ধোঁয়ার মতো। আপনি যত চেষ্টাই করেন, ধোঁয়া চাইপ্পা রাখতে পারবেন না। যারা এখন ক্ষমতায় আছে এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী কে কোথায় কী করতাছে তা দেশের অনেক মানুষই জানে। এখন অনেকেই অনেক কিছু দেখছে, কেউ রেকর্ড রাখতাছে, কেউ চোখে দেখতাছে। নির্বাচনের পর সরকার পরিবর্তন হইলে দেখতে পাইবেন কত খবর বের হয় আর কত মামলা হয়। আমার প্রশ্ন হইল-তাদের দুর্নীতির বিচার হইবে, নাকি তারা ক্ষমতা ছাড়ার আগে দায়মুক্তি নেওয়ার ব্যবস্থা করবে?’ আপনার কী মনে হয়? প্রশ্নের উত্তরে খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলেন মাহতাব। শুধু বললেন, ‘তারা দৌড়ানি খাইব। সবুর করেন। ’
ডিজিটাল যুদ্ধটা কী মাহতাব সাহেব? তার কাছ থেকে জানার জন্য প্রশ্ন করলাম। প্রশ্ন শুনে পকেট থেকে একটি স্যামসাং অ্যান্ড্র্রয়েড ফোন বের করলেন। তারপর ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্স হ্যান্ডেল, হোয়াটসঅ্যাপে তার অ্যাকাউন্টগুলো দেখালেন। তার অ্যাকাউন্টগুলো একেকটি একেক নামে। সবকটিতেই তিনি খুব সক্রিয়। তিনি বললেন, ‘আগামী নির্বাচন যখনই হয় তখন যুদ্ধটা হইব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। নানা প্রযুক্তি ব্যবহার কইরা প্রচার-অপপ্রচার হইব। মিথ্যা ও অপপ্রচারে মানুষ পাগল হইয়া যাইব। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় বৈষম্যবিরোধী নামে কিছু মানুষ, এনসিপির নেতা-কর্মী এবং জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা খুব সক্রিয়। ডিজিটাল জগতের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হইল অসহিষ্ণুতা। যে ভাষায় একজন আর একজনকে গালাগাল করে তা ভাবা যায় না। মনে হয় যেন একেকজন গালাগাল শেখানোর কোচিং সেন্টার খুইল্লা বসেছে। এটা না হয়ে সবাই যদি ভদ্রোচিতভাবে কথা বলত তাইলে ভালো হইত। আমরা যত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছি, তত বেশি অসভ্য হচ্ছি। খুব আফসোস লাগে স্যার। ’
মাহতাব আরও অনেক প্রশ্ন করেছেন, আরও অনেক কথা বলেছেন। তার প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়েছি। তার জিজ্ঞাসায় আমার লেখার অনেক প্রভাব আছে, সেটাও বুঝতে পারছিলাম। একজন সাধারণ অথচ সচেতন মানুষ দেশ নিয়ে কত কিছু ভাবছেন। আর দেশ যাদের হাতে তারা কী ভাবছেন? তার প্রশ্নগুলোই এখন দেশের সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি যেন আমজনতারই প্রতিনিধি। তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমার নেই। জানলেও এ মুহূর্তে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মাহতাবের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তার জানার আগ্রহ অনেক বেশি। দেশ নিয়ে তার ভাবনা সত্যি প্রশংসনীয়।
বিদায় নেওয়ার আগে মাহতাব বললেন, ‘স্যার এতক্ষণ তো দেশ-দুনিয়া নিয়ে অনেক কথা বললাম। এখন আপনাকে দুইটা কথা বলতে চাই। কিছু মনে কইরেন না। সারা দিন তো অনেক চাপের মইধ্যে থাকেন। নিশ্চয় ধর্মকর্ম করেন। নামাজ-রোজা করেন। তার পরেও সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে তিনটি গান মাঝেমইধ্যে শুনবেন। মন ভালো হইয়া যাইব। একটি হইল রবীন্দ্রসংগীত “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি”। আরেকটি হইল নজরুলগীতি “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে”। আর যদি আধ্যাত্মিক বাউল গান শুনতে মন চায় তাইলে শুনবেন “নদী ভরা ঢেউ, বোঝ না তো কেউ, কেন মায়ার তরী বাও বাও গো-”। ’ এ গানের লাইন সুর করে গেয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য মাহতাব আমার দিকে হাত বাড়ালেন। বিদায় দেওয়ার জন্য আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, ভালো থাকবেন। জবাবে মাহতাব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু একটু হাসলেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন