এ কথা অনস্বীকার্য যে, জাতির সামনে প্রস্তাবিত জুলাই সনদ উপস্থাপনার আগে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের দীর্ঘ আলোচনা শেষে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সফল পরিসমাপ্তি ঘটানো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটানো ছিল একটি পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক অধ্যায়।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সেই মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা সেদিন গঠন করেছিল এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ নামক এই পর্যুদস্ত রাষ্ট্রটিকে উদ্ধার করে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপ দেওয়া। বাংলাদেশের জনগণ কখনো রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেনি। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, এই নির্যাতিত-নিষ্পেষিত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রত্যাশা উপেক্ষা করা পরবর্তী সরকারের পক্ষে সহজ হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ‘জুলাই আমাদের পুনর্জন্মের মাস। তাই আমাদের নতুন পথ রচনা করতেই হবে। ’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ফ্যাসিবাদ যেন আর মাথা চাড়া দিতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
৫ আগস্টের মধ্যে সেই কাঙ্ক্ষিত সনদ ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের ইতিহাসে বহু রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, বহু শাসকের পালাবদল ঘটেছে; কিন্তু জনগণের ভাগ্যের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। ঘুণে ধরা সেই রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা জাতীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ সংস্কার সাধিত হয়নি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্র কিংবা জনগণের অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও ষড়যন্ত্রকারী ও শোষকগোষ্ঠীর অপতৎপরতায় সে সময়গুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। সে কারণে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তির আগেই সংগ্রামী ছাত্র-জনতার দাবিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ডাকে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে মোট ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে।
সদ্যঃসমাপ্ত ৩১ জুলাই পর্যন্ত সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ২৩ দিন ধরে এই মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা চলেছে। সেখানে সংস্কারের প্রশ্নে মোট ১৬৬টি সুপারিশের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি বিষয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে; যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৫৩ বছরের মধ্যে এটিই আমাদের প্রথম রাজনৈতিক দলীয় সম্মিলিত রাষ্ট্র মেরামত ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আনীত সংস্কার প্রচেষ্টা, যা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ বলে বিবেচনা হয়েছে।
দেশে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ‘মব জাস্টিস’-এর মতো অরাজকতা স্থান করে নিয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে পুলিশ প্রশাসন ভেঙে পড়ার কারণে সেই অরাজকতাগুলো সংঘটিত হতে পেরেছে। দেশের শান্তিকামী মানুষ অবিলম্বে তার অবসান চায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সংস্কারগুলোকে শুধু মৌখিকভাবে নয়, আইনানুগ কিংবা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি না দেওয়া গেলে ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন সরকার সেগুলো বিভিন্ন অজুহাতে অগ্রাহ্য করতে পারে। সুতরাং প্রস্তাবিত সংস্কার সংবলিত ‘জুলাই সনদ’ কিংবা ঘোষণাগুলো তখন কাজির গরুর মতো খাতাপত্রে থাকলেও গোয়ালে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে।
যে ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছা গেছে তার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ আরো কিছু বিষয়। উল্লেখিত বিষয়াদি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শেষে একটি গ্রহণযোগ্য ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এসেছে, যা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তি বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা অসমীচীন হবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ প্রায় ৫৩ বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে নিজেদের সুবিধা বা স্বার্থ অনযায়ী সংবিধানের কিছু পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজন ছাড়া মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সর্বদলীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে শাসন পদ্ধতিতে ক্রমে ক্রমে স্থান করে নিয়েছে ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি, নৈরাজ্য। সর্বদলীয়ভাবে যে মৌলিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাকে অবশ্যই গঠনশীল, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে ঐতিহাসিক বলে সীমিতভাবে হলেও অভিহিত করা যায়। এখন বাকি সবকিছু নির্ভর করছে গৃহীত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলোর সফল বাস্তবায়নের ওপর। রাজনৈতিক কিংবা সাংবিধানিক পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাতারাতি সব পরিবর্তন কিংবা সংস্কার একসঙ্গে সম্পন্ন করা অতীতে কখনো তেমনভাবে সম্ভব হয়নি। সে কারণেই ধাপে ধাপে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর সেটিকেই গণতান্ত্রিক মহল বলে থাকে ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’।
চুয়ান্নতে মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারা। কিন্তু পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেয়। সেই থেকে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মুক্তি আন্দোলনের পথে রাজনীতি পরিচালনা করছিলেন ভাসানী। সাতান্ন সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় নীতিগত কারণে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন ভাসানী। তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন তাঁর ছয় দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি। তারই ধারাবাহিকতায় সূচিত হয়েছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। তাতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। শেখ মুজিব সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করতে পারেননি। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। আর একাত্তরে পাক হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়লে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার এক অভ্যুত্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামল এবং পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে প্রচুর আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে। কিন্তু বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অভাবে স্থিতিশীলতা আসেনি কখনো। ক্ষমতা দখলের চক্রান্তে কিংবা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কারণে গণতান্ত্রিক মতাদর্শ কখনোই থিতু হতে পারেনি বাংলাদেশে। ফলে বারবার জন্ম নিয়েছে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ। সেই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বিগত চব্বিশের জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব এবং জুলাই ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম। বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে এই রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সহযোগিতা প্রদান করেছে। আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি সুবর্ণপথ বিনির্মাণ করবে।
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক