৪ আগস্ট ২০২৪। তখন ঘোর বর্ষা।
বেলা ১২টা নাগাদ খবর এলো—শহরে জড়ো হচ্ছে ছাত্র-জনতা। বড় জমায়েতে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে ফেনীতে এর আগের দিনগুলোতেও ছাত্ররা মাঠে নেমেছিল। আন্দোলন করেছে। তাদের ওপর হামলা হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। শহরের ট্রাংক রোডে, শহীদ মিনারে, জেল রোড ও বড় মসজিদের সামনে ছাত্রদের পাশাপাশি অনেক ছাত্রীকেও হেনস্তা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা।
এসব কারণে আন্দোলনকারীরা বড় জমায়েত না করে খণ্ড খণ্ড হয়ে আন্দোলন করেছিল। তেমন বড় জমায়েত হয়নি। সূত্রে খবর এলো, ৪ আগস্টের জমায়েত অন্যদিনের মতো হবে না। শিক্ষার্থীরা অন্যদিনগুলোর চেয়ে জমায়েত বাড়াবে এবং শক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠে থাকবে।
এমন খবর পেয়ে অফিসকে জানালাম। ফুলগাজী থেকে শহরে যাওয়া দরকার। অফিসও সায় দিলো। আমরা যখন শহরে আসি তখন দুপুর। ছাত্ররা সেদিন শহরের মহিপালে অবস্থান নিয়েছিল। শহর ছাড়াও সেদিন বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিল এখানে। ফ্যাসিবাদ উৎখাতের স্বপ্নে বিভোর টগবগে ছাত্র-জনতার স্লোগানে মুখর হয়ে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপালসহ আশ-পাশ।
ছাত্ররা তখন একত্রিত হয়ে জোহরের নামাজও পড়েছিলেন রাস্তায়। নামাজ শেষে দোয়া করছিলেন বিপ্লবে সারা দেশে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের জন্য।
এদিকে পৌরসভাসহ বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হচ্ছিল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মহিপালের বিপ্লবীদের কাছে খবর গেল, ব্যাপক অস্ত্র জমা করে তাদের দমনে নামবে সন্ত্রাসীরা। তবু বিপ্লবীরা পিছু হটেনি এক পা। সেখানেই অবস্থান করেছিল বুকভরা সাহস ও তেজোদ্দীপ্ত হয়ে।
সন্ত্রাসীরা এক পর্যায়ে রণপ্রস্তুতি নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহিপালের দিকে এগুলো। সবার হাতেই অস্ত্র। কারও হাতে দেশি আবার কারও হাতে বিদেশি অস্ত্র। কারও হাত খালি নেই। যার যা আছে তা নিয়েই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিন। গদি টেকাতে মরিয়া তাদের উন্মত্ত নেতারাও ছিলেন সেদিন অগ্রভাগে। সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন হাজারী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীলসহ দলীয় নেতারা সেদিন প্রকাশ্যেই নির্দেশনা দিচ্ছিলেন খুনের অভিযানে। একাধিক ভিডিও ফুটেজেও তা স্পষ্ট। বাকিদেরও ফুটেজ দেখে সহজেই চেনা যাচ্ছিল।
নিরীহ আন্দোলনকারীরা মহিপালেই অবস্থান করেছিলেন। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। দু-একজনের হাতে লাঠি হয়তো ছিল, প্রায় সবার মাথায় ছিল কেবল লাল-সবুজের পতাকা। নিরস্ত্র এই ছাত্রসমাজের ওপর সম্মুখ থেকে শুরু হলো হামলা। একের পর চলতে থাকে এক গুলি। যেন গুলির বৃষ্টি ঝরছিল সেদিন। সারাদিন ফুলগাজী-পরশুরামে যে বৃষ্টি প্লাবন তৈরি করেছিল, মনে হচ্ছিল, তার চেয়েও প্রবল এই গুলির বৃষ্টি।
একের পর এক রক্তাক্ত লাশ পড়ছিল রাস্তায়। আহাজারি-চিৎকারে মহিপাল ছাড়িয়ে পুরো ফেনী শহরের আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। তবু বুকভরা সাহস নিয়ে আন্দোলনকারীরা ধরে রাখে ময়দান। সবচেয়ে নির্মম ছিল পাসপোর্ট অফিসের সামনের চিত্রটা। একসঙ্গে তিনটা লাশ কাছাকাছি পড়েছিল। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলে ঘণ্টাব্যাপী। ধারণকৃত ভিডিওগুলো দেখলেই বোঝা যায় খুনিরা যেন টার্গেট করে পাখি শিকার করছিল। একটার পর একটা গুলি ছুঁড়ছিল, আর প্রাণগুলো লুটে পড়েছিল রাস্তায়।
সরকারি হিসাবে সেদিনের শহীদের তালিকা আটজনের হলেও অসমর্থিত সূত্রের তথ্য অনুসারে, ওইদিন লাশ পড়েছিল ঢের বেশি। অনেকেই ভয়ে স্বজনের লাশ হাসপাতালে না নিয়ে গোপনেই কবরস্থ করেন।
লাশগুলো যখন এক এক করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেটি এখনো স্পষ্ট দৃষ্টিসীমায়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে মাটিতে রাখা হয়েছিল রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো। সে কী অবহেলা। কী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হচ্ছিল লাশগুলো নিয়ে।
আমার সঙ্গে তখন ছিলেন সহকর্মী দুলাল তালুকদার ও অনুজ জাহিদ রাজন। এদিকে আমার অফিস থেকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল, ঘটনার ফুটেজ ও খবর যেন লিখে দ্রুত পাঠাই। কিছুই যেন হাতে উঠছিল না। এত লাশ, এত রক্ত দেখে কি ঠিক থাকা যায়!
তবু নিজেকে শান্ত রেখে তথ্য নিচ্ছিলাম। এদিকে সহকর্মীদের অনেকে পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেও নিজের মানবিক দিকটা যেন চেপে রাখতে পারছিলেন না। দুলাল তালুকদার আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিচ্ছিলেন। অপর সহকর্মী আতিয়ার সজল ভাই নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে আহত লোকদের উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে পাঠিয়েছিলেন।
একটা বিষয় সেদিন আলাদাভাবে নজর কেড়েছিল। তৎকালীন সরকারি দলের ক্যাডার বাহিনীর চোখ রাঙানিসহ নানা কারণে ডাক্তাররা ইচ্ছে থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া দিতে পারছিলেন না, কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা ছিল চোখে পড়ার মত। একজন সনাতনী নারীর ছবিতো এখনো চোখে ভাসে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আহতদের সেবা দিচ্ছিলেন আর খুনিদের ভর্ৎসনা করছিলেন ।
অনুজ রাজনও আহতের স্বজনদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। নিউজ সংগ্রহের মেজাজে আমরা কেউই ছিলাম না। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, কয়েকটি লাশ থেকে প্রথম আমার সামনে শহীদ শ্রাবণের লাশ শনাক্ত করেন তার কয়েকজন বন্ধু ও সহপাঠী। পরবর্তীতে স্বজনরা আসেন। সে কী আহাজারি তাদের। আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠেছিল।
পরদিন ৫ আগস্ট, পুরো শহর যেন থমথমে। যেন কোথাও কেউ নেই। তবে মোড়ে মোড়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী মহড়া চলছিল। রহস্যজনকভাবে পুলিশ সব থানাতেই। বাইরে তেমন দেখা গেল না। অফিস থেকে বলা হলো একটা লাইভ দিতে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছিলো না। উপায় না পেয়ে মহিপাল থেকে একটা অ্যাজ-লাইভ দিয়েছিলাম।
সঙ্গে রাজনও ছিল। যেন ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়েছিলাম। ফেরার পথে জহিরিয়া মসজিদের সামনে আসতেই চোখে পড়ছিল, কারা যেন রাস্তায় নামাজ পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখলাম এক স্বেচ্ছাসেবক গায়েবানা জানাজার ইমামতি করছিলেন। নামাজ শেষে তার চোখগুলো টলমল করছিলো।
এর কিছুক্ষণ পরেই আমার ফোনে একটা রিং বাজলো। ওপাশ থেকে একজন জানালেন ছাত্র-জনতার জয়ের খবর। পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো চলছে। রাজনকে বললাম, চলো। দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে এসেই দেখলাম একটি সাম্রাজ্যের পতন। আমাদের বাসার ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছিল, মাস্টার পাড়া থেকে একদল গুলি করতে করতে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছিল। অপরদিকে ট্রাংক রোড থেকে বিক্ষুব্ধ জনতা এগুচ্ছিলো খুনে বাহিনীকে ধরতে মাস্টার পাড়ার দিকে। এরপর যা ঘটেছে, সেটা সবার জানা ।
সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বছর পেরিয়ে গেল। বেশ কয়েকটি হত্যা মামলাও হলো, কিন্তু চিহ্নিত খুনিদের তেমন কেউ গ্রেপ্তার হলো না। সেই অস্ত্রের অধিকাংশের হদিসও মিলল না। শহীদ পরিবার ও বিপ্লবে আহতদের এসব নিয়ে হতাশা কম নয়। প্রশ্নও অনেক। সেসবের সুরাহা কে করবে। কখন করবে কিংবা আদৌ হবে কিনা শঙ্কা রয়েই গেছে।
জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের সেই দিনগুলোতে অনেক তেজোদ্দীপ্ত শিক্ষার্থীকে দেখেছি। স্কুল পড়ুয়া অনেক কিশোরকে দেখেছি। রাজপথে ওদের সাহসের পদযাত্রা দেখে নিজের প্রতি ঘৃণা হতো। নিজের অস্তিত্বের প্রতি প্রশ্ন জাগতো। কেন ওদের মত নয়। ফের চিন্তায় আসতো চাকরি, সন্তান, সংসার। আরও নানা অসহায়ত্ব।
সেই মুখগুলোর অনেককে এখন আর দেখি না। অগ্রসারির কেউ কেউ শহীদের মর্যাদা পেয়েছে। অনেকেই হয়তো বিপ্লব শেষে সহপাঠীর স্মৃতি বুকে নিয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে।
এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে কাফনের কাপড় পরা মিছিলের সামনের সেই ছাত্রীদের ছবি। কী সাহস ওদের! এত ‘মহাক্ষমতাধর’ শাসক গোষ্ঠীকে পরোয়া না করে কাফনের কাপড় পরে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল দীপ্ত পায়ে।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় জেলায় ছয়টি থানায় সাতটি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। যেখানে এজাহারনামীয় আসামি দুই হাজার ১৯৯ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি চার হাজার। গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ১১ জন। বাকিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।
অপরদিকে আসামি গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বাদীপক্ষের (হতহাতদের) আইনজীবীরা।
একটি মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসডিয়াম সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী রয়েছেন।
মহিপালের এই হত্যাযজ্ঞ, যা রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে কোনো জেলা শহরে একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহাণির ঘটনা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রকৃত খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে এই আন্দোলনের বেদনা যেমন থাকবে, তেমনি বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এমন নৃশংসতার। দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে শহীদ পরিবারের অন্তত সামান্য সান্ত্বনা ফিরিয়ে আনতে। এত এত রক্তের বিনিময়ে যে বিপ্লব, তা যেন বেহাত না হয়। বাঙালির ইতিহাসে ২৪ অমলিন থাকুক চিরকাল।
লেখক: সাংবাদিক
এইচএ