ঢাকা: সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। ১, ২, ৩ ও ৪ জুলাই ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে আগারগাঁওয়ের মূল সড়ক। ৪ ঘণ্টা পর অবরোধ উঠলেও থামেনি তাদের আন্দোলন। দুদিন পর ৯ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন থেকে দুপুরের দিকে পেছন দরজা দিয়ে বের হচ্ছি। মোটর সাইকেল সামান্য একটু দূরে যেতেই থেমে যায় চাকা। শিক্ষার্থীরা ঘিরে রাখে সড়ক। অনুরোধ করে বের হতে চাইলে শেরেবাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলে উঠলেন আপনাদের পরিবারের সবাই কি কোটায় চাকরি পেয়েছে? যদি তাই না হয় তাহলে আপনারাও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর এক একটা দিন যায় সরকারের নিপীড়ন বাড়তে থাকে। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও জোরদার হতে থাকে। এর মধ্যেই চলে আসে ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি। অংশ নেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। একই দিন আন্দোলন চলাকালে মিরপুর ১০ নাম্বারে সহকর্মী জি এম মুজিবুর আহত হন। অফিস থেকে খবর এলে আন্দোলনের মধ্যেই আমি এবং সহকর্মী জাফর আহমেদ ছুটে চলি মিরপুর ১৩ নং সেকশন অবস্থিত আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে। যদিও সেদিন মোবাইল নেটওয়ার্ক অনেক ভোগান্তি দিয়েছে তারপরও কোনো মতে হাসপাতালে পৌঁছে সহকর্মী জিএম মুজিবরের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিই। সন্ধ্যা নামতেই মনে হচ্ছিল ভুতুড়ে নগরী দিয়ে চলছি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে ভয় এবং আতঙ্ক এর আগে কখনো এত কাজ করেনি। এলোমেলো খবরেও মৃত্যুর সংখ্যা ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আন্দোলন ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকার সান্ধ্যকালীন আইন জারি করে। এরই মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। একদিন পর সকালে সহকর্মী জাফর আহমেদ কারফিউতে চলাচলের জন্য পাশ নিয়ে আসেন শেওড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু ভেতরে সড়কে। আমি এবং রেজাউল করিম রাজা পাশ সংগ্রহ করে চলি ডিউটিতে। একই দিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম ঠিক ১০ নং সেকশন আসতেই চোখে পড়ে আগুনে ছাই হয়ে গেছে মিরপুর ১০ এর পুলিশ বক্স, সাঁজোয়া যান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, নিরাপত্তার ব্যাপক শঙ্কা রয়েছে। ধীরে ধীরে মোটরসাইকেলে এগিয়ে গেলেও বিকট বিকট শব্দে পরিবারের সদস্যদের কথাই মনে পড়েছে।
২১ ও ২২ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেও আন্দোলন দমাতে পারেনি তৎকালীন সরকার।
২৩ জুলাই কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস ২৪ জুলাই থেকে চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়ার ঘোষণা আসে।
২৬ জুলাই থেকে পাড়া মহল্লার অলি গলিতে শুরু হয় ব্লক রেড। নিরীহ মানুষও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি। এ যেন একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানায়। চলে গণ গ্রেপ্তারও। আন্দোলনে কাজের চাপও বাড়তে থাকে আমাদের। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের চেহারা দেখে বের হতাম, মনে মনে শঙ্কা তো ছিলই, রাতে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরতে পারবো কি-না, এভাবেই এক এক দিন যেন এক একটা মাস মনে হয়েছে।
৩ আগস্ট দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন ও ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর জনতার মধ্য থেকে এক দফার দাবি ওঠে। ভয়, শঙ্কা এবং আতঙ্ক নিয়ে মাঠে কাজ করলেও মনে হয়েছে পতন শুধু সময়ের ব্যাপার। এরপর এলো মার্চ ফর ঢাকা কর্মসূচি। ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি থাকলেও ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় এটা একদিন এগিয়ে নিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়।
সারাদেশকে সরকার পক্ষ থেকে অচল করা হলেও দাবিয়ে রাখতে পারেনি জনগণকে। সেদিন বেগম রোকেয়া সরণীতে কর্মরত দাঁড়িয়ে দেখেছি কারফিউ ভেঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা।
নীরবতা ও আতঙ্ক কাটিয়ে কোটি কোটি আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে বিজয়ের স্লোগান এ এক অন্যরকম বাংলাদেশ। এবারের বিজয়ের স্বাদটা নির্যাতিত শোষিত মানুষের আলোর মিছিল। কোটা থেকে এক দফার আন্দোলন, এ যেন আতঙ্কের নগরীতে হার না মানা জুলাই।
হাসিনার পতনের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসী দেখল এক নতুন বাংলাদেশ।
এসএমএকে/এসআইএস